Spread the love

ডাঃ দীপালোক বন্দোপাধ্যায় : ২২ জুলাই, ২০২৪। ভারতীয় সামাজিক , আধ্যাত্মিক ও ধর্মীয় জীবনে
আষাঢ়ী পূর্ণিমার এই দিনটি ” গুরু পূর্ণিমা ” বা”ব্যাস পূর্ণিমা নামে খুবই গুরুত্ব পেয়ে আসছে ৷ হিন্দু সমাজে গুরু বা শিক্ষক ছিলেন সর্বোচ্চ স্থানের অধিকারী ৷ তিনি ঐশী শক্তির মূর্ত প্রকাশ ৷
ব্রহ্মজ্ঞ ও তত্ত্বজ্ঞ ৷ “গু” মানে “কু” বা অন্ধকার আর “রু” অর্থ “সু” বা শুভ আলো ৷সেই আলো সূর্যের থেকে বেশী দীপ্তমান আবার চাঁদের চেয়েও স্নিগ্ধ !যিনি আঁধার ঘুচিয়ে আলোর পথ দেখান ৷গুরুকে ব্রহ্মা , বিষ্ণু ও মহেশ্বর বলা হয়েছে ৷ কারন , তিনি সৃষ্টি , স্থিতি ও লয়ের পরম জ্ঞান দান করেন ৷ ” গুরু গোবিন্দ দুয়ো খাড়ে , কাকে লাগ্যু পায় / বলিহারি গুরু আপনে যিন গোবিন্দ দিয়ো বাতায়ে “৷ অর্থাৎ গুরু ও ভগবান একসাথে থাকলে আগে গুরুকে প্রণাম করতে হয় ৷ ” গুরু রেখে যে গোবিন্দ ভজে / তার দেহ নরকে মজে ” তাই , বৈষ্ণব শাস্ত্র বলেছে কৃষ্ণ রুষ্ট হলে গুরু রক্ষা করতে পারেন ৷ কিন্তু , গুরু যার প্রতি ক্ষুব্ধ হন তাকে ঈশ্বরও রক্ষা করেন না ৷ সব গুরুর মধ্যেই রয়েছে এক গুরুতত্ব ৷ কখনো অন্যের গুরুকে তাই নিন্দা করতে নেই ৷ গুরু আধ্যাত্মিক জগতের পথ দেখান ৷তবে, মন্ত্র দেওয়া গুরু ছাড়াও বাবা -মা , শিক্ষক , এমনকি বইয়ের মত জড় পদার্থ ও নিজের বৌদ্ধিক সত্ত্বাকেও গুরু বলা হয়েছে ৷ ঋষি পরাশর ও মৎস্যগন্ধা সত্যবতীর জারজ সন্তান হয়েও ব্যাসদেবের জন্ম তিথিতে গুরু পূর্ণিমা পালিত হয়ে আসছে ৷ কারন তিনি আমাদের জাগতিক ও আধ্যাত্মিক শক্তির বিকাশ ঘটান ৷ ব্যাসদেব বেদকে চার ভাগে বিভাজিত করে ‘মহাগুরু ‘ নামে পরিচিত হয়েছেন ৷ বেদের অনন্ত বিদ্যা একজনের পক্ষে একত্রে গ্রহন কঠিন ৷ তাই ,
তিনি তাঁর চার শিষ্য – পৈল ( ঋক) , জৈমিনি( সাম)
বৈশাম্পায়ন( যর্জু) ও সুমন্তকে অর্থব বেদ দেন ৷
রবীন্দ্রনাথের মতে “ভারতের চিরকালীন ইতিহাস
মহাভারত” ৷ এক লক্ষ শ্লোকের এই বিশাল গ্রন্থ বেদব্যাসের রচনা ৷ এরই ভীষ্ম পর্বের ১৮ টি অধ্যায় নিয়ে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ দার্শনিক গ্রন্থ ” শ্রীমদ্ভাগবতগীতা ” ! ১৮ টি পুরাণ ও ১৮ টি উপপুরাণও তাঁর লেখা বলে মনে করা হয় ৷ তাঁর সেরা সৃষ্টি ৫৫৫ সূত্রের বৈদিকসিদ্ধান্তগুলিকে ” ব্রহ্মসূত্র” হিসাবে প্রকাশ ৷ এই ব্রহ্মসূত্র থেকেই হিন্দুদের সবমত ও পথের উৎপত্তি ৷ একেক সাধক একেক ভাবে তাঁদের শিষ্যদের কাছে ব্রহ্মসূত্রের ব্যাখ্যা করেছেন ৷ উপনিষদ বলেছে ,” ভূমৈব সুখম” ৷ ভূমা মানে ব্রহ্ম ৷ জীবের উন্নতি , আত্মজ্ঞান লাভ ও আত্মার মুক্তির জন্য এই আষাঢ়ী পূর্ণিমা বা গুরু পূর্ণিমার পুণ্য তিথিতে ভগবান আবির্ভূত হয়েছিলেন ৷ আচার্য , উপাধ্যায় , ঋত্বিক বা পুরোহিত সম্মানীয় হলেও শ্রেষ্ঠ হলেন “গুরু “৷ আমাদের প্রথম শিক্ষালাভ মায়ের কাছে ৷ তাই “মা” হলেন শ্রেষ্ঠ গুরু ৷ এরপর “বাবা” ৷ তাঁরাই নরাকারে পরব্রহ্ম ৷ পৌরাণিক , তান্ত্রিক , কুলগুরু সহ দেহধারী গুরু না থাকলে পিতা-মাতাকে গুরু হিসাবে এদিন প্রণাম করলে গুরুপুজোর ফল পাওয়া যায় ৷
“গুরু পূর্ণিমা – ভারতে উৎপন্ন সব ধর্মের উৎসব ৷ হিন্দু , জৈন , বৌদ্ধ ও শিখ ৷
“মহাদেব” হলেন আদিগুরু ৷ তিনি সপ্তর্ষি – অত্রি,
বশিষ্ঠ, পুলহ , পুলস্থ্য , অঙ্গীরা , মরীচি ও ক্রতু এঁদের মহাজ্ঞান যোগসাধনার সাতটি পদ্ধতি শিক্ষা দিয়ে আদিযোগী থেকে হন আদিগুরু ৷চুরাশি বছর ধরে এই সাত ঋষি নিজেদের তৈরী করেছিলেন ৷ তারপর যেদিন পৃথিবীর গতিপথ উত্তর থেকে দক্ষিণ মুখী হল সেদিন গুরু পূর্ণিমা তিথিতে আদি যোগী সেদিন দক্ষিণ মুখী হয়ে এনাদের যোগ বিদ্যার শিক্ষা দেওয়া শুরু করেন ৷প্রসঙ্গত বলা দরকার যোগ বিজ্ঞান মানে নিঃশ্বাস ধরে রাখা বা শরীর দোমড়ানো মোচড়ানো নয় ৷ মানবতন্ত্রকে বোঝার বিদ্যা ৷ সব সৃষ্টির অস্তিত্বকে বোঝা ৷ সৃষ্টি থেকে সৃষ্টিকর্তা পর্যন্ত পৌঁছানোর জ্ঞান ৷এদিন ভগবান মানুষকে স্মরণ করান জীবন পূর্ব নির্দিষ্ট নয় ৷নিজে আপ্রাণ চেষ্টা করলে সৃষ্টির প্রত্যেকটি দরজা খুলে যেতে পারে ৷আদি গুরু শিষ্যদের সেই রাস্তা দেখিয়ে গেছেন ৷ শিব গুরু সম্বন্ধে বলেছেন ,”গুরুদেবো গুরুধর্মো , গুরু নিষ্ঠ পরান তপঃ ৷ গুরুঃ পরতরম নাস্তি , ত্রিভরম কথ্যামি তে … অর্থাৎ গুরু ব্রহ্ম , গুরু ধর্ম আর গুরুর প্রতি আনুগত্য পরম ধর্ম ৷ জীবনে গুরু হলেন ব্রহ্মা -বিষ্ণু -মহেশ্বর ৷ তিনি আমাদের সৃষ্টি-স্থিতি-লয়ের পরম ব্রহ্মজ্ঞান দান করন ৷গুরু পূর্ণিমা হলো প্রাচীন “ভারতের শিক্ষা দিবস ” ৷ ‘সত্যম নাস্তি পরমো ধর্ম’ অর্থাৎ সত্যের চেয়ে উচ্চতর ধর্ম নেই ৷নিজে ধর্মকে রক্ষা করলে ধর্ম আপনাকে রক্ষা করবে বা ধর্মো রক্ষিতি রক্ষাতাঃ ৷এদিন আমরা ও শিক্ষকদের শ্রদ্ধা জানাই ৷ আষাঢ় মাসের পূর্ণিমা তিথির এই দিন আমাদের কাছে ” ব্যাস দিবস “৷ এদিন সর্বশ্রেষ্ঠ জ্ঞানী তথা গুরু ব্যাসদেবের জন্ম ৷ অন্ততঃ পাঁচ হাজার বছর আগে এই তিথিতে
তাঁর জন্ম ৷ এই বিশেষ তিথিতেই তিনি তাঁর ” ব্রহ্মসূত্র” লেখা
শেষ করেন ৷তাই তাঁকে সর্বশ্রেষ্ঠ গুরু মেনে ২১৬
স্তোত্রের তাঁরই লেখা ” গুরু গীতা ” পাঠ করা হয় ৷
শুধু আধ্যাত্মিকতা নয় – সঙ্গীত , দর্শন , চিত্রকলা সবেতেই গুরুর দরকার ৷ গুরু একটি পরম্পরা বা
সিঁড়ি ৷ এই সিঁড়িতে উঠতে উঠতে আমরা আদিগুরুর বা পরমগুরুর সন্ধান পাই ৷ “দীক্ষা” হলো দেহ, মন ও আত্মার ঐকান্তিক মিলন ৷
গুরু – শিষ্যের সুন্দর বন্ধন ৷ আমি মনে করি সব
জ্ঞানান্বেষণ প্রথমে “দীক্ষা” বা ” বায়েত” মূলক ৷
তারপর শিক্ষা মূলক ৷ হিন্দু ঐতিহ্য মেনে তাই এই দিন নেপালে “শিক্ষক দিবস ” পালিত হয় ও সরকারি ছুটি থাকে ৷ ব্রিটিশরা আসার আগে ভারতবর্ষে পূর্ণিমা ও অমাবস্যায় ছুটি থাকত ৷ মানুষ ঐ সময় মন্দিরে গিয়ে নিজের মঙ্গলের সব প্রক্রিয়া সাধন করত ৷ কিন্তু , ইংরেজরা খ্রিস্টানদের সুবিধার জন্য রবিবার ছুটি ঘোষণা করে ৷সেই থেকে ভারতীয়রা ধর্মীয় কাজের বদলে ছুটির রবিবারটা আমোদ আহ্লাদ , খানা পিনায় কাটায় ৷ আর ভারতীয় ধর্মগুলির পূর্ণিমা অমাবস্যা তিথি পালন কমে যায় ৷আমি মনে করি আমাদের সব ধর্মীয় ক্রিয়াকর্মের মধ্যে রয়েছে বিজ্ঞানের ছোঁয়া ৷ দেখুন ” গুরু পূর্ণিমার ” শুভ দিনটি থেকে
৬ মাস সূর্য উত্তরায়ণ থেকে দক্ষিণায়নের পথে যায় ৷গুরু আসলে আলো বা এনলাইটেনমেন্ট এবং পূর্ণিমা মানে মনের পূর্ণাবস্থা ৷ এই দিনে সূর্য বা সত্তা ও পূর্ণিমা অর্থ পূর্ণ মন গুরুর কাছ থেকে আর্শীবাদ স্বরূপ আলো উপহার পায় ৷ আসলে আগামী ৬
মাসতো আমাদের নিজ নিজ প্রকৃতি অনুসারে সাধনার সময় ৷ এটা গুরুর কাছে আর্শীবাদ পাওয়ার সময় ৷ মানুষ গুরু না পেলেও প্রকৃতি বিশ্ব গুরু হিসাবে তার সাথে থেকে তার চারপাশে আলো দিয়ে যায় ৷ এজন্য গুরুপূর্ণিমার দিন মন যা চায় তাই প্রার্থনা করতে হয় ৷ তাতে পাওয়া যায় গুরু শক্তির প্রেরণা ৷ তিনি আলো জ্বালিয়ে আমাদের পথ পার করান ৷ এভাবে আমরা দক্ষিণায়নের পথ থেকে উত্তরায়ণের উত্তরণের পথে পা বাড়াই ৷বুদ্ধদেব বোধিজ্ঞান লাভের পর এই তিথিতে সারনাথের ঋষিপত্তন মৃগদাবে প্রধান পাঁচ শিষ্য -কৌন্ডন্য , বপ্প , ভদ্দীয় , মহানাম ও অসসজিতের কাছে তাঁর প্রথম ধর্ম উপদেশ দিয়েছিলেন ৷ এদিনে প্রতিষ্ঠিত হয় “বৌদ্ধধর্ম” ৷ আর ধর্মরক্ষার্থে চালু হয় ” ধর্মচক্র” ৷বর্ষার শুরু ধরে এরপর থেকে তিনমাস বৌদ্ধ শ্রমণ ও ভিক্ষুরা মঠের বাইরে যান না ৷ যাকে পালি ভাষায় বলা হয় ” বসসা” পালন ৷
থাই বৌদ্ধরা পালন করেন “খাও ফানসা ” ৷ হিন্দুদের মত জৈনরা এই দিন থেকে শুরু করেন
“চাতুর্মাস” বা চার মাসের ধর্মনিষ্ঠার পর্ব ৷সংযম
ব্রত ৷এই দিনে মহাবীর “গৌতম মুনি”( স্বামী) কে তাঁর প্রধান শিষ্য হিসাবে দীক্ষা দিয়েছিলেন ৷ গুরু গোবিন্দের পর শিখরা “গ্রন্থসাহেবকে” গুরু হিসাবে মেনে চলেন ৷গুরু নানক বলেছিলেন ,” এক হাজার সূর্য বা চাঁদে হৃদয়ের আঁধার দূর হয় না ৷ যা দূর হয় একমাত্র গুরুর কৃপায় “৷ জীবনের প্রথম গুরু বা শিক্ষক বাবা-মা ৷ এদিন প্রথমেই যেন তাঁদের শ্রদ্ধা জানাই ৷তারপর যাঁদের গুরু আছে তাঁকে ৷ নচেৎ , মহাদেব বা শ্রীকৃষ্ণকে বা ইষ্ট দেবদেবীকে গুরু হিসাবে পুজো দিতে পারেন ৷মাতৃজঠরে আমাদের প্রথম জন্ম , গুরু দীক্ষায় দ্বিতীয় , নাম জপ ও মন্ত্রে রুচি এলে তৃতীয় এবং বীজ
মন্ত্রের রূপ দেখতে পেলে হয় চতুর্থ জন্ম ৷সূর্যের অবস্থান থেকে চাঁদ ১২ ডিগ্রী দূরত্ব অতিক্রম করলে তিথি পরিবর্তন হয় ৷ সূর্য ও চন্দ্র সম ডিগ্রীতে থাকলে হয় অমাবস্যা তিথি ৷ এভাবে ১৫-তম তিথি পূর্ণিমা ৷ গুরুপূর্ণিমা বা ব্যাসজয়ন্তী পালিত হয় উত্তরষাঢ়া নক্ষত্রে চন্দ্রোদয় ব্যাপিনী তিথিতে ৷ এবারে “গুরু পূর্ণিমা ” বা ব্যাস পূর্ণিমা ২১ জুলাই ২০২৪ রবিবার ( ৫ শ্রাবণ১৪৩১) পড়েছে ৷২০২৪ সালে এই তিথিতে থাকছে মঙ্গলদায়ী সর্বাথ সিদ্ধি যোগ ৷ এছাড়া হচ্ছে প্রীতি বা প্রেম যোগ ৷ আমাদের আধ্যাত্মিক , আধিভৌতিক ও আধিদৈবিক তিনরকম দুঃখ থেকে রেহাই মেলে গুরুপূর্ণিমা পালনে ৷ তাই উৎসব উদযাপনের উদ্দেশ্য আনন্দলাভ ৷ যদিও অনেকে এদিন দিনের বেলা উপবাস করে আবার কেউ আমিষ খাবার থেকে বিরত থাকে ৷ গুরুকে নিবেদন করে ফল , দই , ক্ষীর , লাড্ডু , হালুয়া , মিষ্টি , বাদাম , আলু সহ মূল জাতীয় সব্জি খায় ৷ ধ্যানের মাধ্যমে জ্ঞানান্বেষণ করতে হয় ৷
” গুরু ব্রহ্মা , গুরু বিষ্ণু , গুরু দের্ব মহেশ্বর ৷ গুরু
সাক্ষাৎ পরমব্রহ্ম তস্মৈ শ্রী গুরুবে নমোহঃ “৷
জয় গুরু ৷ গুরু কৃপাহি কেবলম্ !