বিপ্লব মন্ডল : কলকাতা, ১ সেপ্টেম্বর, ২০২৪। পুলিশ দিবসের শুভেচ্ছা সবাইকে।আজ পুলিশ ডে পালিত হলো আনুষ্ঠানিকভাবে। এমন একটা সময়ে যখন একজন পুলিশকর্মীর জঘন্য এবং পৈশাচিক কাজের জন্য সমস্ত স্তরের সমস্ত পুলিশকর্মী কাঠগড়ায়। পুলিশকে উদ্দেশ্য করে বন্যা বয়ে যাচ্ছে গালাগালির। বানিয়ে ফেলা হচ্ছে মিম। মিডিয়া বা সোশ্যাল মিডিয়ায় যত বেশি ব্যঙ্গ, যত বেশি গালাগালি, যত বেশি কটাক্ষ, যত বেশি কুরুচি, তত বেশি লাইক, তত বেশি শেয়ার, তত বেশি ভিউজ, তত বেশি টিআরপি।
এমন একটা চাকরি, যাতে শনিবার নেই, রবিবার নেই, এমন কি পরিবার ও নেই। এমন একটা চাকরি, যাতে দিন থাকতে নেই, রাত থাকতে নেই, কোনও পরিস্থিতিতেই কোনও অজুহাত থাকতে নেই। এমন একটা চাকরি, যাতে পুজো থাকতে নেই, দোল থাকতে নেই, বড়দিন থাকতে নেই, ভাইফোঁটা থাকতে নেই, সন্তানের স্কুলে পেরেন্ট-টিচার মিটিং থাকতে নেই। বিবাহবার্ষিকী থাকতে নেই, ছেলেমেয়ের জন্মদিন থাকতে নেই। অসুস্থ বাবা-মাকে সেবাযত্নের সময় থাকতে নেই। সন্তানের জ্বর হলে তার মাথায় জলপট্টি দেওয়ারও সময় থাকতে নেই। এই ‘নেই’-গুলোর সঙ্গে মানিয়ে নিতে নিতে পরিবারের লোকেরাও প্রতিদিন একটু একটু করে ‘নেই’ হয়ে যেতে থাকে প্রায় সকল পুলিশের জীবন থেকে।
এই ‘নেই’গুলোর বদলে কী থাকে তাহলে পুলিশের কর্মজীবনে?
থাকে “পুলিশ তুমিও চিন্তা করো, তোমার মেয়েও হচ্ছে বড়”-র মতো উন্মত্ত হুমকি আর অভিশাপ। কিসের হুমকি, কেন অভিশাপ? কারণ কোনও একজন পুলিশ এক চূড়ান্ত নারকীয় একটি অপরাধ করেছে। একজনের অপরাধ, কিন্তু সেই অপরাধের দায় প্রতিটি পুলিশকর্মীর। যে পুলিশকর্মীরা কোভিডের সময় বাড়ি বাড়ি ওষুধ-খাবার এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী পৌঁছে দিতেন নিজের বাড়ি দিনের পর দিন না ফিরে, সেই প্রতিটি পুলিশকর্মীর। যে পুলিশকর্মীরা রোদ-জল-ঝড়-বৃষ্টি-বন্যা-মহামারী-আমফান-এর তোয়াক্কা না করে ৩৬৫ দিন ২৪X৭ ‘ডিউটি’-র বোঝা কাঁধে চাপিয়ে পথ চলেন, একজনের পাপের দায় সেই প্রতিটি পুলিশকর্মীর।
সব পুলিশ কি পাপী? সব পুলিশ কি দোষী? তাই পুলিশের পরিবারের শিশুকন্যাও রেহাই পায় না ন্যায়বিচার চাওয়া জনতার হুমকি থেকে। উন্মত্ত জনতা যাতে ইট-পাথর ছুড়ে রাজপথে নিজের ‘শান্তিপূর্ণ’ প্রতিবাদ জানাতে পারেন, সেটা সুনিশ্চিত করতে গিয়ে পুলিশের দেবাশিস, শম্পারা চোখে পান ইটের আঘাত। কাজের জায়গায় নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করার আন্দোলন সামলাতে গিয়ে নিজেরই কাজের জায়গায় দাঁড়িয়ে নিজেরই কাজ করার বিনিময়ে পুলিশের একটা চোখ চলে যাবে চিরতরে? বিচার চাইবে না কেউ? জাস্টিস? কেউ বলবে না, একজন ডাক্তারের ভুল চিকিৎসার দায় সমগ্র ডাক্তারসমাজের উপর চাপানো যায় না? কেউ বলবে না, একজন ইঞ্জিনিয়ারের গাফিলতিতে ব্রিজ ভেঙে পড়লে তার দায় দুনিয়ার সব ইঞ্জিনিয়ারের নয়? কেউ বলবে না, একজন পুলিশের অন্যায়ের দায় সমস্ত পুলিশকর্মীর উপর চাপিয়ে দেওয়াটা অসুস্থ মানসিকতার পরিচায়ক? কেউ বলার নেই? কেউ বলবে না?
বলবে না, বলছে না। কারণ?
চোপ! প্রতিবাদ চলছে!
বছর গড়াতে থাকে, পুলিশের জীবনও। জনতার অভিশাপ পেতে পেতে অভ্যস্ত হয়ে যাওয়া পুলিশের সন্তানরা মিডিয়া, সোশ্যাল মিডিয়ায় সর্বক্ষণ পায় অফুরন্ত উপচে পড়া ঘৃণা।
এক হাসপাতালে ঘটে যাওয়া এক জঘন্য অপরাধের প্রতিবাদে আপামর জনসাধারণ প্রতিটি পুলিশকর্মীকে সেই অপরাধীর প্রতিভূ ঠাউরে নেয় এবং দিনের পর দিন চলতে থাকে গালাগালি আর বিষোদগার। চলতেই থাকে। কারণ, জানা তো আছেই, পুলিশ কখনও তার প্ৰতি ঘটে চলা অন্যায়ের বিরুদ্ধে অনির্দিষ্টকাল কর্মবিরতির ডাক দিতে পারবে না। ‘ডিসিপ্লিনড ফোর্স’, তাই কাজ করে যাবে ওরা। ইটপাথর খেয়ে, চোখ হারিয়ে, উঠতে-বসতে গালাগালি খেয়ে।
প্রশাসনের সবচেয়ে দৃশ্যমান মুখ হয়ে কাজ করতে হয় বলেই কি সমালোচনার সর্বোচ্চ হ্যালোজেন শুধুমাত্র পুলিশেরই মুখের উপরে?
যে দেশে শুধু ২.২ শতাংশ লোক ইনকাম ট্যাক্স দেয় , সেখানে হঠাৎ করে সবাই আজ সৎ হয়ে গেল আর পুলিশের সবাই হয়ে গেল শাসক এর পা-চাটা চাকুরে বা চোর। আশ্চর্য! বলতে পারেন, নিজস্ব ব্যবসা ছাড়া এমন কোনো একটি পেশা আছে, যেখানে চাকরিদাতার বিরুদ্ধে ইচ্ছে করলেই বিদ্রোহ ঘোষণা করা যায়? মতের অমিল হলেই কষ্টার্জিত চাকরি ছেড়ে দেওয়া যায়? আছে এমন কোনও পেশা, যা নিয়মের উর্দ্ধে? যাঁরা মিডিয়ায় কাজ করেন, তাঁরা মিডিয়া হাউসের পলিসির বিরুদ্ধে গিয়ে নিজের ইচ্ছেমতো স্টোরি করতে পারেন? যাঁরা প্রাইভেট সেক্টরে কাজ করেন, তাঁরা কি সবাই বিপ্লবী? মালিকের নীতি অনুযায়ী কাজ করেন না তাঁরা? ফেসবুক-বিপ্লবীরা যাঁরা পুলিশের মা-মাসি উদ্ধার না করে এখন জলগ্রহণ পর্যন্ত করছেন না, তাঁরা নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে সবাই ভয়ঙ্কর বিপ্লবী? সবাই এক একজন চে গুয়েভারা? সব বিপ্লবের দায় পুলিশের? কেন ভাই?
অন্য কোনও পেশার কর্মীদের কোনও কাজ যখন আমাদের পছন্দ হয় না, তখন কি আমরা তাদের বাড়ির মেয়েদের নিয়ে স্লোগান বাঁধি? পুলিশের পরিবারের কতজন ছেলে মেয়ে তাদের চাকুরিজীবি বাবা- মাকে শনিবার বা রবিবার , পুজো হোক বা ইদ , লকডাউন হোক বা বনধ , স্কুলের অ্যানুয়াল ফাংশান হোক বা গার্জেন মিট, অথবা যে কোনও আপদে-বিপদে, সুখে বা দুঃখে কাছে পায়? বুঝুন একটু ভাই, পুলিশের মেয়ে যদি কোনও লড়াই করে বেড়ে ওঠার কথা বলছে তাহলে এটাই সেই লড়াই। অনেক দুঃখে বলছে। সমাজের সহনাগরিক হয়ে তার এই মানসিক লড়াইয়ের কথা বলছে। করোনার সময় আপনি বাড়িতে বসে সেই মেয়েটার বাবা-মায়ের জন্যই বাড়িতে বসে ওষুধ পেয়েছিলেন, কিন্তু সেই মেয়ের বাবা-মা যখন মারণ-সংক্রমণের ঝুঁকি নিয়ে সারাদিন কাজ করে বাড়িতে ফিরত, তখন মেয়েকে স্পর্শ করার স্বাধীনতাও তাঁদের থাকত না। শুধু চোখের দেখা-ই, পাছে সংক্রমণের ছোঁয়া লাগে। সেই লড়াইয়ে আপনি পুলিশের মেয়ের পাশে ছিলেন? যদি সেই লড়াই না বুঝতে পারেন, তাহলে আপনি সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন এক সুবিধাবাদী এবং আদ্যন্ত ধান্দাবাজ একটি প্রাণী, যে শুধু নিজেরটাই বোঝে, নিজেরটাই বুঝে এসেছে। পুলিশ যে ইউরেনাস-নেপচুন-প্লুটো থেকে নেমে আসা কোনও বস্তু নয়, এই সমাজেরই অংশ, এই সমাজেরই ফসল, এই সহজ সত্যিটা বুঝেও না বোঝার ভান আর কতদিন করবেন?
তিলোত্তমার বিচার চাই। একশোবার চাই, হাজারবার চাই, লক্ষবার চাই। শুধু মনে হয়, এইরকম সুবিচার কেন চাওয়া হয়নি গ্রেটার কুচবিহারের আন্দোলনে দায়িত্বরত অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মুস্তাক আহমেদের জন্য? যাঁকে কর্দমাক্ত ডোবায় ফেলে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়েছিল। কোথায় ছিল মহিলা পুলিশ কর্মীদের অন-ডিউটি নিরাপত্তা, যাঁদের যৌনাঙ্গে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল ধারালো কঞ্চির টুকরো? পুলিশে চাকরি করে বলেই কি হাসপাতালের বিছানায় তাঁদের যন্ত্রণায় ছটফট করার কথা কোথাও আলোচিত হয়নি? পুলিশ বলেই কি ‘ঘন্টাখানেক সঙ্গে অমুক’-এর সভা বসেনি টেলিভিশনে? কেন মানুষ পথে নেমে আসেনি যেদিন খিদিরপুরের কর্তব্যরত আই পি এস অফিসার বিনোদ মেহতার চোখ উপড়ে নেওয়া হয়েছিল? প্রতি বছর ২১শে অক্টোবর কতজন কর্তব্যরত অবস্থায় মৃত পুলিশকর্মীদের শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করা হয় তার হিসেব রেখেছেন কখনও? পেশাগত ঝুঁকি বা প্রফেশনাল হ্যাজার্ডের কথা বলছেন? জানি ভাই জানি, কিন্তু প্রাণ তো প্রাণই, যার যায়, তার যায়। তার পরিবারের যায়, তার প্রিয়জনদের যায়। ন্যূনতম সহমর্মিতা যদি তখন না দেখিয়ে থাকেন, আপনার অধিকার আছে আজ পুলিশের দিকে আঙ্গুল তোলার?
আচ্ছা, পুলিশ দপ্তর যদি কোনও একদিন কর্মবিরতি পালন করত বারিকুল থানার ওসি প্রবাল সেনগুপ্ত বা দার্জিলিংয়ে অমিতাভ মালিকের নিষ্ঠুর হত্যার প্রতিবাদে? কিন্তু ওই যে, ফেসবুক-বিপ্লবী আপনি তো জানেনই, পুলিশ সে পথে যাবে না কোনওদিন। সুতরাং নিশ্চিন্তে আহত, রক্তাক্ত পুলিশকর্মীর ছবিতে ‘হাহা’ ইমোজি দিতে থাকুন। কারণ, আপনি তো জানেনই, পুলিশ হল ‘কাজের বেলায় কাজী, কাজ ফুরোলেই পাজি’ গোত্রের। তাইনা?
আর কতটা বিরোধিতা অতিক্রম করলে পুলিশকে মানুষ বলে ভাবা যায়? “কতটা পথ পেরোলে পাখি জিরোবে তার ডানা” লাইনটা কি পুলিশের কথা ভেবেই লেখা হয়েছিল?
আবার বলছি কাদম্বিনী দ্রুত বিচার পাক। অপরাধীদের কঠিনতম শাস্তি হোক।