Spread the love

শু ভ জ ন্ম দি ন রু না লা য় লা

“আর্টিস্টরা হচ্ছেন বাতাসের মতো। আমাদের নির্দিষ্ট কোনো বাসস্থান বা শেকড় নেই। নির্দিষ্ট কোনো গণ্ডির মধ্যে আমাদের আবদ্ধ করা বোকামি ছাড়া কিছু নয়… আমি নিজেকে ছিন্নমূল ভাবি না, আমি বরং পুরো বিশ্বেরই অন্তর্গত।”

[ রুনা লায়লা ]

বাবলু ভট্টাচার্য : ‘বন্ধু তিনদিন তোর বাড়িতে গেলাম’, ‘আল্লাহ মেঘ দে’, ‘একা একা কেন ভালো লাগে না’, ‘ইস্টিশনে রেলগাড়িটা’, ‘সাধের লাউ’- আরও শ’খানেক নাম বলা যাবে এমন অসাধারণ জনপ্রিয় বাংলা গান যার কণ্ঠে শুনে আমরা অভ্যস্ত, তিনি রুনা লায়লা।

সময় গড়িয়ে যায়, কিন্তু এই গানগুলোর মুগ্ধ করার ক্ষমতা কমে না, বরং দিন দিন বেড়েই চলে।

রুনা লায়লার বাবা সৈয়দ মোহাম্মদ এমদাদ আলী কলকাতার কাস্টমস অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ বিভাগের কর্মকর্তা ছিলেন এবং মা অমিতা সেন বিদ্যাসাগর স্ট্রিটের গায়িকা ছিলেন। ১৯৪৭ সালে অমিতা সেন এমদাদ আলীর সংসারে আমিনা লায়লা হয়ে আসেন। আর এমদাদ-আমিনার ঘরে জন্ম নেন রুনা লায়লা।

গানের ছোঁয়া এমদাদ আলীর পরিবারে বেশ আগে থেকেই ছিল। বিখ্যাত গায়িকা আঞ্জুমান আরা ছিলেন তাঁর ভাগনী। গানের প্রতিভা রুনার বড় বোন দীনার মধ্যে দেখা দেয় খুব ছোটবেলায়, তাই বাড়িতে ওস্তাদ রাখা হল তাঁর জন্য। মাত্র ৪ বছর বয়সেই দীনা লায়লা তাঁর অসাধারণ সংগীত প্রতিভায় সবাইকে বিস্মিত করেন।

অন্যদিকে, বাবা-মা চাইতেন শিল্পের আরেক ধারা নৃত্যে যেন পারদর্শী হয়ে উঠেন রুনা। তাই করাচির বুলবুল একাডেমি অব ফাইন আর্টসে ‘কত্থক’ ও ‘ভরতনাট্যম’ শেখেন রুনা ৪ বছর বয়সে।

নাচে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নিলেও রুনার মন পড়ে থাকতো গানে। তাই বড় বোন দীনা যখন ওস্তাদ আব্দুল কাদের ভূপালির কাছে গান শিখতেন, তখন বোনের পাশে বসে পাঁচ বছরের রুনা গান শেখা খুব মনোযোগ দিয়ে দেখতেন।

তাঁর এই প্রতিভা কারো নজর এড়ায়নি। বিশেষ করে ওস্তাদ আব্দুল কাদের ভূপালির। শুরু হয় রুনার গানের জীবন। এরপরে তিনি ওস্তাদ হাবীব উদ্দিন আহমেদ, আব্দুল কাদেরের মতো আরও গণ্যমান্য ওস্তাদের সান্নিধ্য লাভ করেন।

১২ বছর বয়স পর্যন্ত রুনার অসাধারণ সংগীতপ্রতিভা শুধু পরিবারের গণ্ডির মধ্যেই ছিল। করাচির সেন্ট লরেন্স কনভেন্টে করাচির ওল্ড বয়েজ অ্যাসোসিয়েশন থেকে আন্তঃবিদ্যালয় গানের প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়েছিলেন রুনা লায়লা।

১৯৬৫ সালে পাকিস্তানি চলচ্চিত্র ‘জুগনু’-তে একটি ১২ বছরের ছেলের কণ্ঠের গানের জন্য তাঁকে প্রস্তাব দেয়া হয়। গানের সংগীত পরিচালক মনজুর হোসেন একমাস রুনাকে প্রশিক্ষণ দেন। রুনার মতে, তাঁর ঈশ্বর-প্রদত্ত কণ্ঠকে প্লে-ব্যাকের জন্য ঘষে-মেজে পলিশ করেছেন মনজুর হোসেন।

‘জুগনু’ ছবিতে প্লে-ব্যাক শিল্পী হওয়ার পর আর পেছনে ফিরে দেখতে হয়নি রুনাকে। ১৯৬৬ সালে উর্দু চলচ্চিত্র ‘হাম দোনো’র জন্য তাঁকে ‘উনকি নাজরোসে মোহাব্বাতকা জো পেয়গাম মিলা’- নামের একটি গজল গাইতে বলা হয়।

এছাড়াও তিনি ‘জানে মান ইতনা বাতা দো’, ‘কাটে না কাটে রাতিয়া’, ‘দিনওয়া দিনওয়া ম্যা গিনু’, ‘হামে খো কার বহত’ ইত্যাদি আরও অনেক বিখ্যাত গান পাকিস্তানি চলচ্চিত্রের জন্য প্লে-ব্যাক করেছেন।

১৯৭০ সালের মধ্যেই তিনি প্রায় ১০০০টি গান রেকর্ড করে ফেলেছিলেন। ১৯৭২ সালে, মাত্র ১৯ বছর বয়সে তিনি তাঁর নিজের গানের অনুষ্ঠান ‘বাজমে লায়লা’ শুরু করেন। এটি করাচি টেলিভিশনে প্রতি মাসে দুইবার দেখানো হতো এবং এটি বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছিল।

তখনকার সময় গান গাওয়ার অর্থ শুধুই গান গাওয়া ছিল। গানের ক্ষেত্রে গায়কের শরীর ও অঙ্গভঙ্গিরও যে একটি ভূমিকা আছে, তা সর্বপ্রথম শেখান রুনা লায়লা। যাকে আমরা ‘পারফর্ম’ করা বলি, তিনি তা-ই করেছিলেন, সেই ১৯৬০ এর দশকে, তা-ও করাচির মতো শহরে।

এর মধ্যেই ১৯৬৮ সালে এসএসসিতে প্রথম বিভাগ ও ১৯৭০ সালে এইচএসসিতে ২য় বিভাগে উত্তীর্ণ হন রুনা। ১৯৭৪ সালে বাবার পরামর্শে সপরিবারে নিজের দেশ বাংলাদেশে আসার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। অথচ ততদিনে উর্দু ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি রুনা ছাড়া চলে না।

তাঁর উর্দু ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি ছেড়ে চলে যাওয়ার শোকে সে বছর ‘ডন’ পত্রিকা ‘এন্ড টু এ গ্লোরিয়াস চ্যাপ্টার’ শিরোনামে ৩ কলামের এক সংবাদ ছাপায়। ‘পাকিস্তানের ছায়াছবি ও টেলিভিশন থেকে রুনা লায়লার শূন্যতা দূর করা কি সম্ভব?’ শিরোনামে একটি নিবন্ধ ছাপা হয় পাকিস্তানের ‘লিডার’ পত্রিকায়।

১৯৭৪ সালে নিজের বাংলাদেশে ফিরে গিয়ে সেইবারই ইন্ডিয়ান কাউন্সিল ফর কালচারাল রিলেশনশিপসের (আইসিসিআর) আমন্ত্রণে ভারত সফর করেন রুনা। এর মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক পাশও করেন। কল্যাণজি-আনন্দজির সুরে হিন্দি ছবি ‘এক সে বারকার এক’- এর টাইটেল সংয়ের প্লেব্যাক ছিল তাঁর প্রথম হিন্দি গান।

এছাড়া ‘দামাদাম মাস্ত কালান্দার’-এর কথা আমরা সবাই জানি- যার জন্য ভারতে তাকতকতর নাম হয়েছিল ‘দামদাম গার্ল’। তাঁর গাওয়া অন্যান্য হিন্দি গানের মধ্যে আছে- ‘দে দে পেয়ার দে’, ‘আও সুনলো’, ‘মেরা বাবু ছেল ছাবিলা’ ইত্যাদি।

বাংলা-হিন্দি-উর্দু ছাড়াও গুজরাটি, পাঞ্জাবী, সিন্ধি, পশতু, বেলুচি, আরবি, পারসিয়ান, মালয়, নেপালি, জাপানী, ইতালীয়, স্প্যানিশ, ফরাসি ও ইংরেজিসহ ১৭টি ভাষায় তিনি গান গেয়েছেন।

পাকিস্তানি সংগীত পরিচালক-সুরকার নিসার বাজমির বেশ কয়েকটি গান গেয়েছিলেন রুনা। মুম্বাইয়ের একটি প্রতিষ্ঠান তাঁকে নিসার বাজমির গান গেতে বলে। রুনা প্রতিদিন ১০টি করে তিনদিনে নিসার বাজমির মোট ৩০টি গান রেকর্ড করেন, যা পৃথিবীর একদিনে রেকর্ড করা সবচেয়ে বেশি গানের জন্য গিনিস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে নাম ওঠায়।

১৯৮২ সালে বাপ্পি লাহিড়ী তাঁর বন্ধু রুনা লায়লার কণ্ঠে লন্ডনে একটি পপ অ্যালবাম তৈরি করেন, নাম ‘সুপার রুনা’। রুনার অন্যান্য গানের মতো এটিও অসামান্য জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। এই অ্যালবামটি রেকর্ড করা হয় লন্ডনের অ্যাবি রোড স্টুডিওসে, যেখানে বিখ্যাত ব্যান্ড বিটলস তাদের গান রেকর্ড করতো। রুনা লায়লা ব্যতীত উপমহাদেশের কেউই এই সম্মান লাভ করেননি। শুধু তা-ই নয়, এই অ্যালবামের ১ লক্ষ কপি বিক্রি হয়েছিল এর রিলিজের দিনই! এর জন্য রুনা পান ‘গোল্ডেন ডিস্ক অ্যাওয়ার্ড’।

রুনা লায়লা স্বাধীনতা-পূর্ব পাকিস্তান এবং স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশকে তো গর্বিত করেছেনই, সেই সাথে বিশ্বের এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্তে বাংলা গান ও বাংলাদেশকে পরিচিত করিয়েছেন।

তিনি ১৭টি ভাষায় ১০ হাজারের মতো গান গেয়েছেন। কনসার্ট করেছেন ম্যাডিসন স্কয়ারে। সিডনি অপেরা হাউজসহ যুক্তরাজ্য, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া, নেদারল্যান্ডস, সিঙ্গাপুর, জাপান, রাশিয়া, সুইডেনসহ এমন সব জায়গায় যেখানে পৌঁছানোর শুধু স্বপ্নই দেখেন অনেক সংগীতশিল্পী।

তিনি আজ পর্যন্ত অসংখ্য পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। এর মধ্যে আছে ভারতের স্যায়গাল অ্যাওয়ার্ড, ২ বার জিতেছেন পাকিস্তানের নিগার পুরস্কার, কালাকার এওয়ার্ড।

বাংলাদেশ থেকে ৬ বার পেয়েছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, স্বাধীনতা পুরস্কার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে তাঁকে দেয়া হয় ফিরোজা বেগম স্মারক স্বর্ণপদক।

রুনা লায়লা ১৯৫২ সালের আজকের দিনে (১৭ নভেম্বর) সিলেটে জন্মগ্রহণ করেন।