ডাঃ দীপালোক বন্দোপাধ্যায় : ২৩ নভেম্বর ২০২৩। ভারতের ভক্তি আন্দোলন ও হিন্দু – মুসলমান মিলনের অন্যতম পুরোধা ছিলেন ” সন্ত কবীর দাস”৷ কবীরের জন্ম ১৩৯৮ খ্রিস্টাব্দে বারণসীর লহর তারা ( লহর তালাব) য় ৷ অনেকের মতে তিনি গরীব মুসলমান তাঁতী ( জোলা) নীমা ঐ মাতা নীরার সন্তান ৷ আবার কেউ বলেন রামানন্দের আর্শীবাদী ফল ভুল করে খাওয়া এক বিধবা ব্রাহ্মণীর সন্তান ৷ তাঁরা বলেন স্বাভাবিক নিয়মে নয় হাতের পাতা থেকে তাঁর জন্ম বলে নাম ,”কর -বীর ” ৷যিনি লোকলজ্জার ভয়ে সদ্যোজাত শিশুকে লহর তালাওতে ফেলে যান ৷ আরেক মতে স্বর্গ থেকে মর্ত্যলোকে তিনি নেমে আসেন ৷ যেখানে তিনি ভূমিষ্ঠ হলেন সেই জলাশয়ের চারপাশে ছিল পদ্ম ফুলের সমারোহ ৷ মৌমাছিরা গুনগুন করছিল ৷ তাঁকে ঘিরে পেখম মেলে ছিল ময়ূর ৷ সেখান দিয়ে যাচ্ছিলেন সদ্য বিবাহিতা নিমা ৷ তিনি তাঁকে কোলে তুলে ঘরে আনেন ৷সেই জোলা পরিবারেই তাঁর বেড়ে ওঠা ৷ প্রতিবেশীরা নিমার কোলে শিশু দেখে আশ্বর্য হয়ে গেলেন ৷ কাজীর কাছে এর নাম চাইলেন ৷ উনি “কবীর” নাম দিলে আশপাশের কাজীরা এসে বললেন তাঁতীর ছেলের এমন আল্লার নাম হতে পারে না ৷ একে হত্যা করো ৷ মেরে ফেলতে গেলে ঐটুকু শিশুর মুখ থেকে বের হলো “মায়ার পৃথিবীতে তোমরা আমাকে চেনো না ৷ আমি জ্ঞান ৷ আমার ধ্বংস নেই “৷ কিন্তু ,গুরু মন্ত্র পান রামভক্ত রামানন্দের কাছে ৷ কাপড় বুনতে বুনতে অসাধারণ তত্ব কথা বলতেন দুই সারির মধ্যযুগীয় হিন্দীতে , যাকে বলে “দোঁহা” ৷
দুই চরণের ঐ দোঁহা পড়ার জন্যই আমি হিন্দীতে
“কোবিদ” কোর্স পড়েছিলাম ৷ “কবীর ” – আরবী শব্দ আল্ কাবীর মানে “মহান” ৷ আল্লাহ্ র ৩৭ তম নাম ৷ শ্রীচৈতন্য , সুরদাস , তুলসীদাস ও মীরাবাঈ সগুণ ঈশ্বরে বা অবতারবাদে বিশ্বাসী ছিলেন ৷ আর কবীর ছিলেন নির্গুণ ঈশ্বরে আস্থাবান ৷
” চিন্তা আয়সী ডাকিনী / কাট কলিজা খায়ে ,
বৈদ বেচারা কেয়া করে / কাঁহা তক দওয়া লাগায়ে !” তাঁর মধ্যে ছিল হিন্দু ভক্তিবাদ ও ইসলামের সুফী পথের সম্বন্বয়ের এক নতুন ধারার প্রকাশ ৷ যাকে “মরমিয়া বাদ” ( Mysticism) বলা যায় ৷কবীরকে কেউ বলেন বৈষ্ণব , কেউ ভাবেন নাথ যোগী আবার অনেকে মনে করেন সুফী ৷তিনি কপালে তিলক কাটতেন ৷ গলায় পরতেন কন্ঠী মালা ৷যিনি বলে গেছেন গীতা আর গায়ত্রী তোমাদের মুখে ৷ আর গোবিন্দ আমার প্রাণে ৷তাঁর কাছে “শব্দ” , “নাম” ও “রাম” হলো মুক্তির পথ ৷ তাঁর রাম হলেন নির্বিকল্প পরমতম তত্ত্ব ৷আত্মা যার অংশ ৷ ভক্তি ও প্রেমে পৌঁছানো যায় সেই পরম সত্যর কাছে ৷ কবীর বলেছেন আত্মা একটি হাঁস ৷ মুক্তি পাওয়ার জন্যই তার দেহে বসবাস ! আসলে তিনি ভক্তি আন্দোলনের এক পথপ্রদর্শক ৷ সংস্কৃত “ভজ” ধাতু থেকে ভক্তি শব্দের উৎপত্তি ৷ এর দু’টি মানে – সেবা করা ও সম্মিলিত করা ৷ ভগবানের কাছে ভক্তের পরিপূর্ণ আত্ম
সমর্পণ ৷ ভক্তি ও ভালোবাসার দ্বারা পরমাত্মা তথা ভগবানের দর্শন লাভ থেকে “ভক্তি আন্দোলনের” শুরু ৷ যেখানে জাত , ধর্ম , বর্ণ , লিঙ্গ নির্বিশেষে সবাই স্বাগত ৷ এতে আচারের প্রাবল্য নেই ৷ নেই ব্রাহ্মণ বা মোল্লার একচ্ছত্র আধিপত্য ৷ভারতে ভক্তি আন্দোলনের সূচনা সপ্তম শতকে দাক্ষিণাত্যে ৷বৈষ্ণব “আড়োয়ার” ও শৈব ” নায়নার ” দের দ্বারা ৷ এই দুই সম্প্রদায়ের যথাক্রমে ১২ এবং ৬৩ জন সাধক সাধারনের মুখের ভাষায় মনের কথায় ভগবৎ তত্ব বলেন ৷ এরপর একাদশ শতকে রামানুজের হাত ধরে ভক্তি মার্গের জোয়ার আসে ৷
নিম্বাকাচার্য ও মাধবাচার্য এবিষয়ে বিরাট গুরুত্ব পালন করেন ৷ ভক্তি আন্দোলন বাংলা ও ওড়িশায় শ্রীচৈতন্য , আসামে শঙ্করদেব – মাধবদেব , মহারাষ্ট্রে নামদেব , পাঞ্জাবে শিখ ধর্মের
প্রতিষ্ঠাতা নানক , উত্তর ও পশ্চিম ভারতে জ্ঞানেশ্বর , রবিদাস , সুরদাস , গোরক্ষনাথ , তুলসীদাস ও মীরাবাঈ বিশেষভাবে ছড়িয়ে দেন ৷
তেমনি চতুর্দশ শতকে অন্যতম প্রধান হিন্দু তীর্থ
বারাণসী( কাশী) তে আর্বিভূত হন সাধক রামানন্দ৷
তাঁরই সুযোগ্য শিষ্য ” কবীর দাস ” ৷”জাতি জুলহা নাম কবীরা / বনি বনি ফিরো উদাসী “৷ তিনি বলতেন
” হিন্দু , তুমি বল আমায় / আমি তো সে নই ,
মুসলমানও নইকো আমি / তবে কোথায় রই “!রবীন্দ্রনাথ কবীর প্রসঙ্গে লিখেছেন ,” দয়া করে হরি জন্ম দিয়েছ নীচ যবনের ঘরে ,/ ভেবেছিনু কেহ আসিবে না কাছে ,/ অপার কৃপায় তব,/ সবার চোখের আড়ালে কেবল / তোমায় আমায় রব৷”
তিনি সঞ্চয়ের বিরোধী ছিলেন ৷ শিষ্য করতেও আগ্রহী ছিলেন না ৷ তবু , প্রায় এককোটি বর্তমানে তাঁর ভক্ত সংখ্যা ৷ কারো মতে তিনি বিবাহিত ৷ ছেলে “কমল” ও মেয়ে ” কমালী ” ৷তবে , কবীরপন্থীরা বলেন তিনি চির ব্রহ্মচারী ৷ অবিবাহিত ৷ এরা তার শিষ্য ও শিষ্যা ৷ তিনি হিন্দু ও মুসলমানদের গোঁড়ামীর বিরুদ্ধে প্রচার করেছেন ৷ কখনো খারাপ মন্তব্য করেন নি ৷ আমি অনেক জায়গায় কবীরের মন্দিরে / মাজারে ঘুরেছি ৷ রাম ভক্ত ৷ তুলসী কাঠি রাখেন ৷ পুরীতে ভারত সেবাশ্রম সংঘের পাশে কবীর চৌবুতুরায় গিয়ে জেনেছি কবীর পন্থের এখন তিনটি শাখা
-উত্তরের শাখা মূলতঃ শিখদের মধ্যে , পাশ্চাত্য শাখা – দাদূ দয়াল ও নিরঞ্জন সম্প্রদায়ের মাধ্যমে এবং পূর্বের শাখা – অন্য হিন্দী ভাষী এলাকা সহ পূর্ব ভারতে ৷” কবীর বীজক” এই শাখার প্রামাণ্যগ্রন্থ ৷ খেমরাজ কৃষ্ণদাসের ” বীজ কমল” আদি গ্রন্থ ৷
শিখদের আদি গ্রন্থ “গুরুগ্রন্থ সাহিবে” (১৬০৩) এবং সপ্তদশ শতকের রাজস্থানী “পঞ্চবাণী” গ্রন্থে কবীরের অনেক দোঁহা রয়েছে ৷ পুরীতে শুনেছি তিন তিন বার সমুদ্রের ভাঙ্গনে শহর ধ্বংস হওয়ার উপক্রম এবং জগন্নাথ মন্দির ভেঙ্গে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিলে পুরীর রাজার অনুরোধে ভক্ত কবীর সাগরকে বলে ভাঙ্গন ঠেকান ৷ শুধু তাই নয় তাঁর কথায় জগন্নাথ মন্দিরের মধ্যে সমুদ্রের গর্জনও শোনা যায় না ৷তাঁর হিন্দু ও মুসলমান উভয় শিষ্য থাকায় মৃত্যুর পর দেহ দাহ না কবর দেওয়া হবে এনিয়ে মতান্তর হলে মৃতদেহ ঢাকা চাদর সরিয়ে দেখা যায় তাতে আছে শুধু গোলাপ” ফুল ” ৷যা কাশীতে হিন্দু শিষ্যরা দাহ করেন ও মুসলমানরা কবর দেন ৷ এখনও পাশাপাশি তা রয়েছে , প্রেমের প্রতীক হয়ে ৷”কহত কবীর মুনহু লোই / হরি বিন রাখন বারন কোই ” ৷১২০ বছর বয়সে ১৫১৮ খ্রিস্টাব্দে সন্ত কবীর নগরের
মঘরে তিনি দেহত্যাগ করেন ৷ ৫০০ তম মৃত্যু বার্ষিকীতে তাঁর সমাধি স্থলে একটি একাডেমী ও আর্ন্তজাতিক গবেষণা কেন্দ্র চালু হয়েছে ৷ আমার মনে হয় আমাদের বিশ্বকবির কথা যিনি ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দে প্রথম ভক্ত কবীরের কবিতার ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশের ইচ্ছাপ্রকাশ করেন ! ক্ষিতিমোহন সেন চার খন্ডে কবীরের বচন প্রকাশ করলে তাতে উদ্বুদ্ধ হয়ে বিশ্বকবি “Songs of Kabir” ইংরেজীতে কবীরৈর রচনা প্রকাশ করেন ৷যা কবীরকে ইউরোপে পরিচিতি এনে দেয় ৷ আইরিশ কবি উইলিয়াম বাটলার ইয়েটসের কবিতাতেও আসে কবীরের হাঁসের কথা “The Wild Swans at Coole ” কবিতায় ৷ তাঁর দোঁহা বা কবিতা বা গানগুলি আজও প্রাসঙ্গিক ৷যা নিজেকে সবার সাথে মানিয়ে চলতে শেখায় ৷দেয় অন্তরকে উপলব্ধির ক্ষমতা ৷বিষধর সাপ তাতে মনকে ছুঁতে পারে না ৷৷কবীরের কথায় বলি যতই উপবাস করি মালা জপি প্রকৃত ভক্তি ছাড়া সব অর্থহীন ৷ ভগবান মন্দির , মসজিদ
গ্রন্থ কেতাবে নেই আছেন শুধু ভক্তিতে ৷
জয়তু সন্ত কবীর দাস ৷ প্রণাম ৷