Spread the love

ডাঃ দীপালোক বন্দ্যোপাধ্যায় : নবদ্বীপ, ২৩ জুন, ২০২৪। বাংলার অন্যতম প্রধান তীর্থস্থান নবদ্বীপে সনাতন হিন্দু ধর্মের বৈষ্ণব , শাক্ত , শৈব সব শাখার মিলন ঘটেছে ৷ নবদ্বীপেশ্বরী পোড়ামা নবদ্বীপের প্রধান আকর্ষণ ৷ পোড়ামা আদতে নীল সরস্বতী ৷ নবদ্বীপ ও পার্শ্ববর্তী এলাকার মানুষ প্রত্যহ এখানে পূজার্চনা করেন ৷রাসের সব ঠাকুরের পুজো এখানে আসে ৷ পোড়ামাকে কেন্দ্র করে ঘোরানো হয় রাসের সব ঠাকুর ৷ শহরবাসীর সমস্ত পূণ্যকর্ম শুরু হয় এখানে এসে ৷ শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত সেই পোড়ামার বটবৃক্ষের পুনরাবির্ভাব হয় জগন্নাথ দেবের স্নান যাত্রার পূণ্যতিথিতে ৷ শোনা যায় কয়েকশো বছর আগে এই বটবৃক্ষ শুকিয়ে গেলে নবদ্বীপের সমস্ত পুরোহিত ও পন্ডিত একযোগে হোম -যজ্ঞ করে এবং ১০৮ ঘড়া গঙ্গার জল ঢেলে বৃক্ষটিকে আবার পুনর্জীবন দেন ৷
সেদিনটি ছিল জগন্নাথ দেবের স্নান যাত্রা তিথি ৷ অর্থাৎ বৈষ্ণব ও শাক্তমত একাকার হয়ে গেছে ৷প্রতিবারের মত আজও অসংখ্য পূণ্যার্থী , পন্ডিতের উপস্থিতিতে পূজাপাঠ ও হোম যজ্ঞের শেষে পোড়ামা স্বরূপ শ্রীধাম নবদ্বীপের পবিত্র বটবৃক্ষটিকে ১০৮ ঘড়া গঙ্গার পবিত্র জল ঢেলে স্নান করানো হয় ৷ বৃক্ষ দেবতা রূপী এই বট গাছটির ঝুরি পোড়ামা এবং সংলগ্ন ভবতারণ শিব ও ভবতারিণী কালী মন্দিরগুলিকে অষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছে ৷ মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যদেবের জন্মভূমি নবদ্বীপের পোড়ামা তাঁর কাছেও ছিল আরাধ্যা ৷ তিনি এখানে পড়েছেন ও পড়িয়েছেন ৷ পোড়ামার জন্মদিন মনে করে রবিবার নবদ্বীপ ধাম সেজে উঠেছে ৷
নবদ্বীপ শহরের অন্যতম প্রধান দ্রষ্টব্য পোড়ামার প্রাচীনত্ব নিয়ে নয় নামকরণ নিয়ে মতভেদ আছে ৷ মনে করা হয় এই মন্দির প্রাঙ্গন ছিল সংস্কৃত ও ধর্ম – সংস্কৃতি শিক্ষার মূল কেন্দ্র৷ এখানে শ্রীচৈতন্যদেবও পড়েছেন বলে মনে করা হয় ৷ অবশ্য তিনি পূর্বস্থলীর বিদ্যানগরেও পড়েছেন ৷
বাংলার অক্সর্ফোড তথা একসময়ের রাজধানী নবদ্বীপের এখানে পন্ডিতদের বির্তকসভা হত ৷ তাই ইনি বিদগ্ধজননী ৷
পড়ুয়াদের মা থেকে পোড়ামা ৷ কেউ বলেন পার্শ্ববর্তী সিমুলিয়া গ্রামের দেবী পরমা এখানে এসে উচ্চারন দোষে পোড়ামা হয়েছে ৷ কুসুমাঞ্জলির লেখক রামভদ্র গোপাল মন্ত্রে সিদ্ধ এক পন্ডিতের সাথে তর্কে পরাস্ত হলে শর্ত অনুযায়ী নিজের ইষ্ট শাক্ত মন্ত্র ছাড়তে উদ্যোত হলে বটগাছ সংলগ্ন মন্দিরটি আগুনে পুড়ে যায় ৷ সাধক প্রাণে বাঁচেন ৷ দুটি ইট রক্ষা পায় ৷ এই ইট দুটির উপর রয়েছে মায়ের ঘট ৷ পোড়া মা বলে নাম “পোড়া মা ” ৷ সাধককে করালমূর্তিতে দেবী দর্শন দেন ৷ তিনি দেখেন দেবীর কোলে গোপাল ৷ নব্যন্যায়ের কেন্দ্রস্থল পোড়ামা তলায় পন্ডিত বাসুদেব সার্বভৌম দক্ষিনাকালীর ঘটটি স্থাপন করেছিলেন ৷ সারাবছর দক্ষিণা কালীর ধ্যানেই পূজিতা হলেও দশমহাবিদ্যার অন্যতম নীল সরস্বতী রূপে সরস্বতী পুজোর দিন শ্রীপঞ্চমী তিথিতে পোড়ামা দেবী পূজিতা হন ৷এখানে স্মার্ত পন্ডিত রঘুনন্দনের টোল ছিল ৷ শ্রীচৈতন্যদেব এখানে টোলে পড়েছেন ও পড়িয়েছেন ৷তন্ত্র সাধক বৃহদ্রথ ,বাসুদেব সার্বভৌম ,কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ , বুনো রামনাথ , গদাধর ভট্টাচার্য , মথুরানাথের মত পন্ডিতদের স্মৃতিধন্য পোড়া মা ৷ এখানকার চতুষ্পাঠী বা টোল ছিল ভারত বিখ্যাত ৷ পরাবিদ্যাদায়িনী মহাশক্তি “পোড়ামা”র পুজো হয় দক্ষিণাকালী মন্ত্রে ৷অনেক বৈষ্ণব পন্ডিতের মতে বৃন্দাবনের পৌর্ণমাসী বা যোগমায়াই নবদ্বীপে কলিযুগে গৌরলীলায় ” প্রৌঢ় মায়া ” চলতি কথায় “পোড়ামা ” ৷ পৌর্ণমাসী যোগমায়া দেবী সর্বদা রাধা-কৃষ্ণ মিলন প্রেয়াসিনী ৷ শ্রীকৃষ্ণের ঐশ্বর্য মাধুর্য ও ঔদার্যগত সব লীলাতেই রয়েছেন যোগমায়া ৷ গৌতমীয় তন্ত্রে যোগমায়াকে বৈষ্ণব মন্ত্রের অধিষ্ঠাত্রী দেবী বলেছেন ৷বৈষ্ণবগণ যোগমায়ার কোলেই হরিনাম সংকীর্ত্তন ও কৃষ্ণসেবা করেন ৷ কৃষ্ণসেবার জন্যই তাঁরা যোগমায়ার শরণাগত ৷ জড় জগৎ হলো জগবানের জড়াশক্তির পরিণতি ৷ জড় মায়া এই প্রৌঢ়া মায়ের ছায়া ৷ এভাবেই হয়েছে বৈষ্ণব ও শাক্তের মিলন ! যিনি প্রকৃত বৈষ্ণব তিনিই শাক্ত আবার প্রকৃত শাক্তই হলেন পরম বৈষ্ণব ৷এভাবে সনাতন ধর্ম একাকার ৷ নদীয়ার (কৃষ্ণনগরের )মহারাজারা এই মন্দির ও সংলগ্ন ভবতারণ শিব ও ভবতারিনী মন্দিরের দেখভাল করেন ৷ নবদ্বীপবাসী যেকোন শুভ কাজ শুরু করেন পোড়ামার পুজো দিয়ে ৷ রাসের সমস্ত প্রতিমা পোড়ামাকে প্রদক্ষিণ করে ৷সারা বছর দেবীর পুজো হয় ৷ নবদ্বীপের পোড়ামা মহাপীঠের আবির্ভাব বা পীঠোদ্ধার তিথি দেব স্নান পূর্ণিমা বা স্নান যাত্রা উপলক্ষ্যে মহাপূজা ভক্তজনেরা উপস্থিত হয়ে দেখেন ৷ নবদ্বীপের প্রাণকেন্দ্র একটি সুপ্রাচীন বটগাছ ও তার শাখা গুঁড়ি বিশিষ্ট পোড়ামাতলায় ৬/৭ শো বছর আগের সুবৃহৎ বটগাছতলায় বিগ্রহ বিহীন মা পোড়ামা ভবানীর থানের সাথেই দেখে আসুন সংলগ্ন মা ভবতারিণী ও নবদ্বীপের বৃহত্তম তথা নদীয়া জেলার দ্বিতীয় বৃহত্তম ভবতারণ জিউ শিবকে ৷প্রচলিত কাহিনী ভবতারিণী মূর্তিটি নাকি আগে গণেশ মূর্তি ছিল ৷ একসময় গঙ্গায় তলিয়ে গেলে নদীয়া রাজ গিরীশ চন্দ্র শুঁড় ভাঙা মূর্তিটি উদ্ধার করলে নবদ্বীপের পন্ডিত সমাজের সিদ্ধান্ত মত অঙ্গহীন বিগ্রহটিকে ধ্যানানুযায়ী ভবতারিণী মূর্তিতে রূপ দেওয়া হয় ৷ বসন পরিহিতা মা ভবতারিণীর হাতে খাঁড়া নেই ৷ তিনি মহাদেবের বুকের উপর বাবু হয়ে বসে আছেন ৷ ২০১৯ সালে পোড়ামাতলাকে হেরিটেজ স্থান হিসাবে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে ৷ জয় পোড়ামা ৷