
ডাঃ দীপালোক বন্দ্যোপাধ্যায় : কলকাতা, ১৩ মার্চ, ২০২৫।
“মধু বাতাহ ঋতায়তে মধু ক্ষরন্তি সিন্ধবঃ ৷
মাধ্বীর্নঃ সন্ত্বোষধীঃ৷৷( যর্জুবেদ ১৩/২৮)৷
ঋতুরাজ বসন্ত বাতাসেও ফুলের সুগন্ধ বয়ে আনে ৷ মন মাতাতে তাই এমন উৎসব ৷ একসময় এইসময়ে নববর্ষের সূচনা হত ৷ ফাল্গুনী পূর্ণিমা তিথিতে উত্তর ফাল্গুনীতে হোলি আসে ৷ নারদ পুরাণ , ভবিষ্য পুরাণ ও জৈমিনী মীমাংসা তে রঙের উৎসবের অনেক কথা আছে ৷ ৩০০ খ্রীস্টপূর্বাব্দের হর্ষবর্ধনের শিলালিপিতে “হোলি “পালনের কথা জানা যায় ৷ তাঁর লেখা “রত্নাবলী ” নাটকেও রঙ খেলার কথা আছে ৷ মধ্যযুগে হোলির ব্যাপকতার বর্ণনা করেছেন আল বিরুণী সহ অনেক মুসলিম লেখক ৷ হিন্দু রাজাদের মত অনেক মুসলমান
সম্রাটও হোলি খেলতেন ৷ “দোলযাত্রা” -‘দোল’ মানে দোলন এবং যাত্রা অর্থ গমন ৷
অন্যতম বৈষ্ণব শাস্ত্র স্কন্দ পুরাণ বলেছে হিরণ্যকশিপুর বোন হোলিকা রাক্ষসী বিষ্ণু ভক্ত প্রহ্লাদকে আগুনে পুড়িয়ে মারতে গিয়ে নিজেই অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা যায় ৷ আমরা জানি কশ্যপ মুনির ছেলে হয়েও হিরণ্যকশিপু ক্ষমতামত্ততায় ঈশ্বর আরাধনা বন্ধ করে ও খারাপ কাজ করতে থাকে ৷ নিজের শিশু পুত্র ভগবানের নাম গান করায় তাকে বিষাক্ত সাপের ঘরে ছেড়ে , বন্য হাতির পায়ে দিয়ে , খাবারে বিষ দিয়ে প্রহ্লাদকে মারতে না পেরে ব্রহ্মার কাছে কখনো পুড়বে না এমন প্রাপ্ত চাদর জড়িয়ে নিজের বোন হোলিকাকে পাঠান ৷ ঐ চাদর গায়ে হোলিকা ভাবে অগ্নি দগ্ধ হবে না ৷ পিসি বলে আদর করে প্রহ্লাদকে কোলে বসিয়ে আগুনে গেলে অসৎ কাজের জন্য হোলিকা পুড়ে যায় কিন্তু ছোট্ট ভক্ত প্রহ্লাদ অক্ষত থাকে ৷ এতে প্রমাণ হয় ভগবান ভক্তকে সর্বদা রক্ষা করেন ৷ হোলিকা দহনের সময় তাই প্রাথর্না করা হয়।
“অহকুটা ভয়ত্রাস্তৈঃ কুতা ত্ব হোলি বালিশৈঃ৷
অতস্বা পূজায়ি স্বামি ভূতি ভূতি প্রদায়িনীম ৷৷”
আবার শ্রীকৃষ্ণকে মারতে মামা কংসের পাঠানো পুতনা রাক্ষসীরই মৃত্যু হয় ৷ এই দুই পুরাকালের দহন কাহিনী এবং শ্রীকৃষ্ণ অত্যাচারী কেশি ও অরিষ্টাসুরকে বধ করেন ৷ এগুলো হলো অশুভের নাশ তথা শুভের জয় ৷ হোলি বা দোলযাত্রা পালনের কাহিনী আমরা পাই ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণের প্রকৃতি খন্ডে , পদ্মপুরাণের পাতাল খন্ডে ও হরিভক্তিবিলাসের চতুর্দশ অধ্যায়ে ৷ পুরানো আবর্জনা , শুষ্কতা সরিয়ে নতুনের আহ্বান আনে ৷ বাংলায় একে বলে “চাঁচর বা ন্যাড়াপোড়া “৷ এই জয় উদযাপনের আনন্দ অনুষ্ঠানই “হোলি “৷ “হোলা” থেকে “হোলি ” এসেছে ৷ হোলি থেকে হোলিকা ৷ এর মানে ডাইনি ৷ এটা ঋতুভিত্তিক ও ফসল তোলারও উৎসব ৷ “বাসন্তীয় নবসস্যেষ্টি হোলকৎসব “৷ ঐসময় ওঠা ডাল জাতীয় শস্য পোড়ালে ছাল জ্বলে গেলেও ভিতরের শস্য সুরক্ষিত থাকে ৷ যজ্ঞ বা হবনে আহুতি দিয়ে গ্রহণ করা হয় ৷ বৃন্দাবনে শ্রীকৃষ্ণ রাধা ও ব্রজগোপীদের সঙ্গে আবির ও গুলাল দিয়ে উৎসব পালন করতেন ৷ কৃষ্ণ নিজের কালো রঙ ঢাকতে রঙ মেখে রাধা ও সখীদের কাছে হাজির হন ৷ অষ্টম শতকে নিম্বাকাচার্যের লেখায় দোলে রাধাকৃষ্ণের যুগল মূর্তি পুজোর কথা আছে ৷ এদিন ষোড়শ বা চৌষট্টি উপাচারে পুজো করা হয় ৷ বাংলায় মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যদেবের জন্ম তিথি গৌরপূর্ণিমা বা দোলপূর্ণিমা ফাল্গুন পূর্ণিমাতে পালিত হয় ৷ শৈব গ্রন্থে শিবের ক্রোধাগ্নির অসুররূপ জলন্ধরের দুর্গাকে পাওয়ার ইচ্ছা ও পরে বোধোদয় হলে মৃত্যুর আগের প্রার্থনা তার দেহত্যাগের দিন সবাই যেন উৎসব মুখর হয় ও রঙে মেতে ওঠে ৷ এ থেকে রঙের উৎসবের সূচনা ৷ আবার শৈব ও শাক্ত বিশ্বাস শিবের ধ্যান ভাঙতে কামদেব তীর বা কামবান ছুড়লে শিবের তৃতীয় নয়নের তেজে তিনি ভস্মীভূত হন ৷ ঐ ভস্ম নিজ অঙ্গে লেপন করে মহাদেব বোঝান তিনি সব কামনা বাসনার ঊর্দ্ধে ৷
কাম বা সব কিছু একদিন চরম সত্য শিবেই বিলীন হবে ৷ পরে পত্নী রতির প্রার্থনায় কামদেবকে শিব ফিরিয়ে আনেন ৷ প্রেমের দেবতা কামদেবের পুর্নজন্ম শুরুর আনন্দে সূচনা
হয় রঙের উৎসব হোলির ৷ “মদনোৎসব” নিয়ে ভবভূতির “মালতীমাধব” নাটকে অনেক কিছু জানা যায় ৷ দেবী পার্বতী মীনাক্ষী রূপে অবর্তীন হলে সুন্দরেশ্বর রূপে শিব এই দোল পূর্ণিমা তিথিতে তাঁকে বিবাহ করেন ৷ আবার কাঞ্চীপুরমে শিব একাম্বরেশ্বর পরমেশ্বরী পার্বতীকে নিয়ে দধীচি মুনির আশ্রমে গেলে দুজনকে দোলনায় বসিয়ে বৈদিক মন্ত্র উচ্চারণ করে রঙিন আবীর দিয়ে আনন্দোল্লাস করা হয় ৷ এসব অনুষ্ঠান তামিল নাড়ুতে” পাঙ্গুনী উথীরাম ” নামে পালিত হয় ৷ কেউ কেউ বলেছেন এই তিথিতে ইন্দ্র শচীকে এবং রামচন্দ্র সীতাকে এবং শ্রীকৃষ্ণ – জাম্ববতীকে এবং কার্তিক দেবসেনাকে বিবাহ করেছিলেন তাই কল্যাণ ব্রত পালিত হয় ৷
বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্যের সুর সনাতন হিন্দু ধর্মের মূল মন্ত্র ৷ বৈচিত্র্যই একঘেয়েমি দূর করে ৷ প্রাণে বল জোগায় ৷
হিন্দুদের অন্যতম প্রধান উৎসব “দোল বা হোলি” তেও
তাই বৈচিত্র্য স্বাভাবিক ৷ একে বলা হয় ফেস্টিভ্যাল অফ কালার্স “৷ বসন্তের রঙে মন রাঙাতে রং খেলার এই উৎসবের শুরু ৷ বিভিন্ন জায়গা ঘুরে এর নানা রূপ দেখেছি ৷ আমরা একে অন্যকে রং ও আবীরে রাঙিয়ে হৃদয়ের নৈকট্যলাভ করি ৷ প্রেমপূর্বক রঙ দিতে হয় ৷বাংলায় আমরা রাধা কৃষ্ণের যুগল মূর্তির আরাধনা করে ভগবানের গায়ে আবীর ছিটিয়ে , পরিবারের বড়দের পায়ে আবীর দিয়ে
রং নিয়ে মেতে উঠি ৷ ভগবানের কলির অবতার শ্রীচৈতন্যদেব এই তিথিতে আবির্ভূত হন ৷ তাই দোল আমাদের কাছে হয়ে গেছে “গৌর পূর্ণিমা ” ৷ “ওরে গৃহবাসী খোল দ্বার খোল ”
গাইতে গাইতে রবীন্দ্রনাথ যৌবনের এই বসন্তোৎসব শান্তিনিকেতনে শুরু করেছিলেন ৷ যা এখন শিক্ষিত মহলে দোল পালন হয়ে দাঁড়িয়েছে ৷ বাংলার পাড়ায় পাড়ায় হয় গোপাল পুজো ৷ পাশের রাজ্য বিহার , ঝাড়খন্ডের ভোজপুরী ভাষায় এর নাম “ফাগুয়া ” ৷ হোলিকা দহনের পর ভোজপুরী লোকগীতি গাইতে গাইতে রং খেলা হয় ৷ সিদ্ধি বা ভাঙ খেয়ে মানুষ খেলায় বুঁদ হয়ে যায় ৷ অসমে একে বলে “ফাকুয়া ” ৷ হোলিকার কুঁড়ে জ্বালানোর পরদিন একে অপরকে রাঙিয়ে উৎসবে মেতে ওঠে ৷ আমার চোখে সবচেয়ে আকর্ষণীয় মনিপুরী দোল ” ইয়াওসাং” ৷ দোল পূর্ণিমায় শুরু হয়ে ছ’দিন চলে ৷ হলফ করে বলতে পারি এই সময় “থাবাল চোংবা” নামের মধুর মনিপুরী লোক নৃত্য একবার দেখলে চিরদিন মনে থাকবে ৷ আরেক বিখ্যাত হোলি রাধা কৃষ্ণের জন্মস্থানের “লাঠমার হোলি ” ৷ শ্রীকৃষ্ণের জন্মভূমি নন্দগাঁওয়ের ছেলেরা এদিন রাধিকার বাড়ী
বারসানায় রং খেলতে গেলে মহিলাদের লাঠিপেটা খায় ৷ এই অভিনয় অসাধারণ ৷ কাশীর শ্মশানে চিতাভস্ম মেখে হোলি খেলা হয় ৷ অনেক জায়গায় যমকে আটকাতে কাদা মেখেও হোলি হয় ৷ নিহাং শিখদের মার্শাল আর্টের অনবদ্য প্রদর্শনী হয় পাঞ্জাবের “হোলা মহল্লা” “৷
সঙ্গে গাওয়া হয় লোকগীতি ৷ বনাঢ্য পোশাক পরে নাচ গান করতে করতে উত্তরাখন্ডের কুমায়ূণের মানুষ “খাদি হোলি ” খেলে ৷ হোলিকা পোড়ানোর পঞ্চম দিনে মহারাষ্ট্র ও মধ্যপ্রদেশে খেলা হয় “রাঙ্গা পঞ্চমী ” বা রং পঞ্চমী ৷ সৌরাষ্ট্রে মানুষের কুশ জ্বালানো হয় ৷ উত্তরভারতে ভেড়ার গায়ে প্রতীকি আগুন দেওয়া , কোথাও ভেরেন্ডা বা বাঁশ বা কলাগাছ জ্বালিয়ে চাঁচর বা বুড়ির ঘর পোড়ানো পালনের পর রঙের উৎসব শুরু হয় ৷ চাঁচরের ছাই পরিষ্কার করে নারীত্ব সঙ্কেত পদ্ম আঁকা আল্পনা দেওয়া বা গৌরী ( গৌরীপট্ট যা দেবীত্বের বা নারীত্বের প্রতীক) গড়ে পুজো করা হয় ৷ দক্ষিণ ভারতে হয় “কামায়ন” ( কাম+ অয়ন বা মদনের যাত্রা শুরু) এবং “মদন দহন” বা কাম নিবৃত্তি পালিত হয় ৷ হোলির লাল রঙ রক্ত এবং সবুজ রঙ পাতার প্রতীক ভাবা হয় ৷ আমার লেখা ধর্মীয় বইগুলি কিনলে বিশদ ব্যাখ্যা পাবেন ৷
গোয়ার হিন্দুদের সঙ্গে দেশী বিদেশী পর্যটকরাও মেতে ওঠে “শিগমো” নামের হোলিতে ৷ যে নাচে থাকে পাশ্চাত্ত্য ছোঁয়া ৷ সুসজ্জিত ঘোড়া নিয়ে রাজকীয় ব্যান্ডের তালে তালে রাজস্থানের উদয়পুরের মেবার রাজ পরিবার “রয়্যাল হোলি” খেলে ৷ অশুভ আত্মার হাত থেকে রেহাই পেতে এখানে হোলিকা দহন চিরায়ত প্রথা ৷ ওড়িশার পুরীর জগন্নাথ মন্দিরে ভগবানের বিজয় বিগ্রহকে এদিনেও সোনার বেশ পরানো হয় ৷ কেরলে হোলির নাম ” মঞ্জল কুলি “৷ গোসারিপুরমের তিরুমালা মন্দিরে
এই উৎসব দক্ষিণ ভারতের মধ্যে সবচেয়ে উপভোগ্য হোলি ৷ দোলে আমরা ভগবানের কাছে নিজের বা পরিবারের বা সম্প্রদায়ের নয় সর্বজীবের কল্যাণ কামনায় প্রার্থনা করি -” “ওঁ শান্তি সবৈ সম স্বস্তি ভবতু , সবৈ শান্তি ভবতু , সর্বৈ শান্তি মঙ্গলম্ ভবতু ৷৷” সবাইকে
দোল পূর্ণিমা / গৌর পূর্ণিমা / হোলির রঙিন অভিনন্দন !