Spread the love

জন্মদিনে স্মরণ : দ্বি জে ন মু খো পা ধ্যা য়

বাবলু ভট্টাচার্য : বাংলা গানের স্বর্ণযুগ বলে যে সময়কালকে চিহ্নিত করা হয়, সেখানে শিল্পীদের সকলেই স্বকীয়তায় বিশিষ্ট। প্রত্যেকের কণ্ঠ ও গায়কি আলাদা করে চিনে নেওয়া যায়। দ্বিজেনবাবুও ব্যতিক্রম নন।

নিজের গানে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার আগে দ্বিজেনবাবু জলসায় শোনাতেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গান। নিজেই বলেছেন, তখন হেমন্তবাবুই তাঁর প্রেরণা।

তাঁর দেখানো পথে হেঁটেই আধুনিক গানের পাশাপাশি রবীন্দ্রসঙ্গীতেরও প্রতিষ্ঠিত শিল্পী হয়ে উঠেছিলেন তিনি। এমনকী তাঁর অনুকরণে দ্বিজেনবাবুরও পোশাক ছিল হাতা গোটানো সাদা শার্ট ও ধুতি।

চিকিৎসক-ঠাকুর্দার সৌজন্যে সচ্ছলতায় ঘাটতি ছিল না। তবে ছোট থেকে গানের ত্রিসীমানায় তিনি কোনও দিন হাঁটেননি। বরং মনে করতেন, গান মেয়েদের জন্য।

সেই তিনি গানের ফাঁদে পড়লেন স্কুলের উঁচু ক্লাসে পড়ার সময়। শ্যামবাজার এ ভি স্কুলে টিফিনের সময় বেঞ্চ বাজিয়ে গান করার সুবাদে এক গানের প্রতিযোগিতায় জোর করে দ্বিজেনবাবুর নাম দিয়ে দেন বন্ধুরা।

পালানোর পথ নেই। অতএব বাড়িতে লুকিয়ে গান গাওয়া। পদক মিলল। সেখানে উপস্থিত সঙ্গীত শিক্ষক সুশান্ত লাহিড়ির নজরেও পড়লেন। তাঁর কাছেই গানের হাতেখড়ি। পরে তালিম নেন কাশীনাথ চট্টোপাধ্যায়ের কাছেও।

প্রথম রেকর্ড অন্তরঙ্গ বন্ধু, পরবর্তী কালে বিশিষ্ট সুরকার নচিকেতা ঘোষের সঙ্গে মেগাফোন কোম্পানিতে। ১৯৪৫ সাল। গান রেকর্ড হল। দ্বিজেন তখন ১৮। নচিকেতাও সমবয়স্ক। বেরলো দুই বন্ধুর গান।

এক বার সাহস করে দুই বন্ধু গেলেন রেডিওতে। ধাক্কা খেতে খেতে অডিশনে উতরে দ্বিজেনবাবুর বরাতে রবীন্দ্রসঙ্গীত। আর গ্রামোফোন কোম্পানি গান রেকর্ড করতে রাজি হলেও সেখানে শুধুই আধুনিক। টুকটাক অনুষ্ঠানও। এই পর্বে চাকরি ছেড়ে দিলেন।

তারও আগে নানা বাঁক ঘুরতে ঘুরতে মহালয়ার প্রভাতী অনুষ্ঠানে কোরাসে গলা দেওয়ার সুযোগ পেয়ে পরিচয় পঙ্কজ মল্লিকের সঙ্গে। বললেন, ‘‘সে দিন রাতে রেডিয়োতে ‘আমি কান পেতে রই’ গান তুমি গেয়েছিলে? আমার ভাল লেগেছে।’’

গোড়া থেকেই দ্বিজেনবাবুর লক্ষ্য ছিল মহালয়ার প্রভাতী অনুষ্ঠানে একক গান গাওয়া। সুযোগ মিলল ১৯৫২ সালে হেমন্তবাবু মুম্বই চলে যাওয়ার সুবাদে। সেই থেকে ‘জাগো, তুমি জাগো’ দ্বিজেনবাবুকে দিয়েই গাইয়েছেন পঙ্কজ মল্লিক। যা সর্ব অর্থে ইতিহাস গড়েছে। তত দিনে গ্রামোফোনে রবীন্দ্রসঙ্গীতের সুযোগও পেয়ে গিয়েছিলেন তিনি।

প্রথাগত ভাবে শান্তিনিকেতনের সঙ্গীতশিক্ষা দ্বিজেনবাবুর ছিল না। তবে ইন্দিরা দেবীচৌধুরানি, শান্তিদেব ঘোষ-সহ সেখানকার গুরুকুলের অনেকের কাছেই তিনি গানের খুঁটিনাটি জেনেছেন। জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে রবীন্দ্র-পুত্র রথীন্দ্রনাথকে গান শোনানোর ডাকও পেয়েছিলেন তিনি।

গণনাট্য সঙ্ঘে ঢুকে সলিল চৌধুরীর সঙ্গে মিলে তৈরি হয় ‘শ্যামলবরণী ওগো কন্যা’, ‘পল্লবিনী গো সঞ্চারিণী’-র মতো বহু জনপ্রিয় গান। সলিলের ডাকে কয়েক বছর মুম্বইতে থেকে বেশ ক’টি হিন্দি ছবিতেও গান গেয়েছেন। তার পর আবার কলকাতায়।

সম্মান, পুরস্কার পেয়েছেন অজস্র। পদ্মভূষণ, বঙ্গবিভূষণ, সঙ্গীত-নাটক অ্যাকাডেমি পুরস্কার, সঙ্গীত-আনন্দ পুরস্কার, একাধিক সাম্মানিক ডি লিট এবং গোল্ডেন ডিস্ক— দীর্ঘ তালিকার কয়েকটি উদাহরণ মাত্র। গান নিয়ে ঘুরেছেন দেশ-বিদেশে।

২০১৮, ২৪ ডিসেম্বর ৯১ বছর বয়সে এই মহান শিল্পী কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন।

দ্বিজেন মুখোপাধ্যায় ১৯২৭ সালের আজকের দিনে (১২ নভেম্বর) কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন।