Spread the love

ডাঃ দীপালোক বন্দ্যোপাধ্যায় : কলকাতা, ১০ মার্চ, ২০২৫।
বৃক্ক বা কিডনি আমাদের দেহের বিশেষ প্রয়োজনীয় অঙ্গ ৷ শিমের বীজের মত দেখতে এই কিডনি দুটি মানব শরীরে রেচন ক্রিয়ায় অংশ নিয়ে দূষিত তরল পদার্থ নির্গমনে সহায়তা করে ৷ আমাদের গৃহীত খাবারে কিছুটা বর্জ্য উৎপন্ন হয় ৷ ঐ সব দূষিত পদার্থ যদি রক্তের সাথে মিশে যায় তাহলে শরীরের স্বাভাবিক কাজে বাধা সৃষ্টি করে ৷
কিডনি বিপাক ক্রিয়ায় উৎপন্ন নাইট্রোজেন ও সালফার জাতীয় দূষিত পদার্থ গুলিকে মূত্র আকারে তরল বর্জ্যের সঙ্গে বাইরে বের করে দেয় ৷ ওষুধের দূষিত অংশও কিডনি দেহ থেকে নির্গত করে ৷ বিভিন্ন ধরনের অম্ল , রেনিন ,হরমোন ইত্যাদি উৎপাদন ও
ক্ষরনে মুখ্য ভূমিকা নেয় ৷ বর্জ্য বের করা ছাড়াও রক্ত তৈরী ও হাড় শক্তিশালী করতে ভূমিকা রাখে ৷ অথচ , কিডনি এমনই
এক গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হলেও কিডনির সামান্য অসুস্থতা বোঝা যায় না ৷ যখন ধরা যায় তখন দুটি কিডনি বিকল হয়ে গেছে ৷ ততদিনে কিডনি বা বৃক্কের কর্মক্ষমতি ৯০% হ্রাস পায় ৷ তাই , মানুষের শরীরে কিডনির গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে ২০০৬ সাল থেকে প্রতিবছর মার্চ মাসের দ্বিতীয় বৃহঃস্পতিবার ( এবারে পড়েছে ১৩ মার্চ)   সারা পৃথিবী জুড়ে সাড়ম্বরে পালিত হয় ” বিশ্ব কিডনি দিবস ৷  ২০২৩এর প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল “কিডনির অসুখ নিয়ে ভাল থাকা “৷ এর লক্ষ্য কিডনি রোগের লক্ষণ ,গুরুত্ব , রোগী পরিচালনা সম্পর্কে সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি ও বিভিন্ন পদক্ষেপ সম্বন্ধে জানানো ৷ ২০২২ সালের প্রতিপাদ্য বিষয় বা থিম ছিলো “সুস্থ কিডনি সবার জন্য জ্ঞানের সেতুবন্ধনে সাফল্য “৷ ২০২১এর প্রতিপাদ্য ছিল ” কিডনি রোগে সুস্থ থাকুন ” ৷ অর্থাৎ কিডনির রোগ নিয়ে কি কি নিয়ম মেনে ও ওষুধ খেয়ে স্বাভাবিক জীবনযাপন করা যায় ৷ ২০২০ -র প্রতিপাদ্য ছিলা” সুস্থ কিডনি সবার জন্য সর্বত্র” ৷ ২০০৬ সালে
International society of Nephrology ( ISN)
এবং International federation of kidney foundation ( IFKF) একযোগে চিকিৎসক ও জনসাধারনের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য এই দিনটি উদযাপন শুরু করে ৷ এখন পৃথিবীতে অন্যতম ভয়াবহ রোগ কিডনির অসুখ ৷বিশ্বব্যাপী ৫-ম মৃত্যুর কারন ৷ এখন ৮৫ কোটি মানুষ কিডনি রোগের শিকার ৷ পৃথিবীর দশ ভাগ মানুষ কিডনি রোগের শিকার ৷ দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগ বা CKD হলো কিডনির কাজে লাগাতার ক্ষতি হওয়া ৷তিন মাস চিকিৎসায় কিডনি রোগ আরোগ্য না হলে তাকে CKD বলে ৷ অর্থাৎ যে রোগ সহজে যায় না ৷ তাই সময়মত রক্ত ও প্রস্রাব পরীক্ষা করা দরকার ৷ডায়াবেটিসের মত উচ্চরক্তচাপও কিডনি খারাপ হওয়ার জন্য দায়ী ৷ কিডনি রোগীর দরকার নিয়মিত রক্তচাপ মাপানো ৷ ইউরিয়া ও ক্রিয়েটিনিন পরীক্ষা করতে হয় ৷গত দশ বছরে কিডনি রোগী বেড়েছে আড়াই গুণ ৷ কিডনি থেকে হার্ট ও মস্তিষ্কের রোগের ঝুঁকি অনেক বেড়ে যায় ৷ আবার হার্ট ও লিভারের রোগও কিডনির রোগ ডেকে আনে ৷ আমাদের মত দেশে এ রোগের জন্য স্বাস্থ্য খাতে বেশী টাকা দেওয়ার দরকার হলেও স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দের দু থেকে তিন শতাংশ মাত্র এ রোগে ব্যয় হয় ৷ প্রতিবছর ২.৪ মিলিয়ন মানুষ দীর্ঘমেয়াদী এবং ১.৭ মিলিয়ন মানুষ আকস্মিক কিডনি রোগে মারা যায় ৷ নিম্ন আয়ের জন্য ৮০% কিডনি রোগী ডায়ালিসিস ও কিডনি সংযোজন করতে পারেন না ৷ প্রতিস্থাপনের খরচ প্রায় ৮-১০ লক্ষ টাকা ৷ তারপর সারাজীবন ওষুধের ব্যয় বহন করতে হয় ৷ ক্যান্সারের মত এ রোগও আগে থেকে বোঝা যায় না ৷ ডায়ালিসিস করে ভালো রাখা গেলেও এ ব্যবস্থা দীর্ঘকাল চালানো কঠিন ৷ সপ্তাহে তিন দিন ডায়ালিসিস বেশ কঠিন ও খরচ সাপেক্ষ ৷ শুধু বাংলাদেশেই দু কোটি লোক নানারকম কিডনি রোগে আক্রান্ত ৷ এরমধ্যে ৪০-৫০ হাজার মানুষ ডায়ালাইসিসের মাধ্যমে জীবন ধারণ করেন ৷ এর বিকল্প হলো কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট ৷ কেউ কিডনি দিলেই তা সম্ভব ৷ প্রতি বছর ১৫ লক্ষ মানুষ এ রোগে মারা যান ৷ ক্রনিক UTI ( Urinary tract infection), বিষধর সাপের কামড় , কীটনাশক ও বিষাক্ত খাবার খাওয়া ও কৃষিক্ষেত্রে সঠিক যত্ন না নিয়ে কীটনাশক দেওয়া , দীর্ঘকালীন ডায়রিয়া , অম্ল , ডিহাইড্রেশন , ডায়াবেটিস , ধূমপান, সর্বোপরি ইচ্ছামত ডাক্তার না দেখিয়ে ওষুধ খাওয়া কিডনি
আক্রান্ত হওয়ার প্রধান কারন ৷ নেফ্রাইটিস বা বৃক্কের ছাঁকনির অসুখ , হার্ট ও যকৃতের অসুখ কিডনি তাড়াতাড়ি নষ্ট করে দেয় ৷ প্রস্রাবে ৩০-৩০০ মিলি মাইক্রো এলবুমিন নির্গমন হলে চিন্তা আছে ৷ সিরাম ক্রিয়েটিনিন , eGFR পরীক্ষা করতে হবে ৷
এই দিনে আমাদের শপথ নিতে হবে সময় মত উচ্চ রক্তচাপ , সুগার দেখাবো ৷ ওষুধ খাবো ৷ ফাস্ট ফুড , জাঙ্ক ফুড বাইরের খাবার ও অতিরিক্ত লবণ এড়িয়ে চলবো হাঁটা , ব্যায়াম , নিজেকে কর্মঠ রাখার চেষ্টা করবো ৷ দিনের বেলায় সঠিক পরিমাণে তরল গ্রহণ , ধূমপান না করা ,প্রস্রাব পেলে আটকে রাখবো না , রক্তে সুগারের অবস্থার নিয়মিত পর্যবেক্ষণ ও প্রস্রাবের অসুবিধা -যেমন প্রস্রাবে জ্বালাভাব , বারবার প্রস্রাব , প্রস্রাবে দুর্গন্ধ ,ঘুমের সমস্যা , ক্ষুধামান্দ্য , মুখ ,হাঁটু পা ফোলা ,কোমরের দুপাশে ও তলপেটে খুব ব্যথা , ছোট ছোট শ্বাস , ত্বকে গোটা বের হওয়া চুলকানি , পিছনে ব্যথা , উচ্চ রক্ত চাপ, বমি ভাব দেখা এবং প্রস্রাবের ফ্রিকোয়েন্সির পরিবর্তন দেখা দিলে ভয় নয় তবে সর্তক হবো ৷ পিছনে ব্যথার ৯০% হয় স্পাইন থেকে , কিছু ক্ষেত্রে টিউমার থেকে ৷ কিন্তু , ১০% কিডনি বা বৃক্কের জন্য হয় ৷ তাই , স্বাস্থ্য সম্মত খাবার খাওয়া , ওজন
নিয়ন্ত্রনে রাখতে হবে ৷ পরিমিত মাত্রায় দৈনিক ৮-১০ গ্লাস বিশুদ্ধ জল খেতে হবে ৷ ইদানিংকালে SGLT 2i নামের ডায়াবেটিসের ওষুধ কিডনির ক্ষতি হ্রাস করে বলে বলা হচ্ছে ৷ যেমন বলা হচ্ছে VASOPRESSIN ( V 2) receptor antagonist পলিসিস্টিক কিডনি রোগের ক্ষতি কমাতে পারে ৷
হোমিওপ্যাথি ও আয়ুর্বেদ চিকিৎসাতেও কার্য্যকর চিকিৎসা রয়েছে ৷ পাথরকুচি , পদ্মপাতা , পুর্ণনবা , পলাশ , গোখুরা কিডনি থেকে টক্সিনগুলি বের করে দিতে পারে ৷ বংশগত রোগ প্রবণতা (Chronic Miasm) এবং শারীরিক ও মানসিক গঠনগত (Constitutional traits) দিক দেখে হোমিওপ্যাথি ওষুধ দিলে ভাল সুফল দেয় ৷ এমনকি ডায়ালিসিসের পাশাপাশি হোমিও চিকিৎসা রোগীকে অনেক ভাল করে ৷ এপিস মেল , ক্যান্থারিস , লাইকোপোডিয়াম , কুপ্রাম মেট ও আর্স , বারবারিস ভালগারিস , অরাম মিউর , কোনাভ্যালেরিয়া লক্ষণ অনুযায়ী দিলে বেশ কাজে আসে ৷ এই প্রতিবেদকের “রোগ পরিচয় ” বইটিতে এমন বহু রোগের কথা আছে ৷ উচ্চমাত্রার ইউরিক এসিড ও ইলেক্ট্রোলাইটস কিডনি থেকে বেড়িয়ে যায় ৷ তবে , সুষম খাদ্য গ্রহণ করা ও বিশৃঙ্খল জীবনযাপন না করে ভাল থাকার চেষ্টা করার বিকল্প নেই ৷