স্মরণ : ক রু ণা ব ন্দ্যো পা ধ্যা য়
বাবলু ভট্টাচার্য :নাম শুনলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের অমর চরিত্র ‘সর্বজয়া’। সত্যজিৎ রায় তাঁর ‘পথের পাঁচালী’ ও ‘অপরাজিত’ ছবিতে এই সর্বজয়ার চরিত্রকে রূপ দিতে ডেকে নিয়েছিলেন বাল্যবন্ধু ও সহকর্মী সুব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্ত্রী করুণাকে। আর তার পরে করুণা ও সর্বজয়া মিশে গিয়েছিল এক অভিন্ন সত্তায়।
করুণা হলেন এমন এক বিশেষ অভিনেত্রী, যিনি শুধু অভিনয় দিয়ে তাঁর অভিনীত চরিত্রদের অমর করে রেখে গিয়েছেন। সংখ্যায় অল্প হলেও গুরুত্বে তারা বিপুল।
ফলে ‘পথের পাঁচালী’ ছবিতে করুণা বন্দ্যোপাধ্যায়ের যুক্ত হওয়া নেহাত কাকতালীয়, এমনটা বলা উচিত হবে না। করুণার কাছে ‘সর্বজয়া’ও অপরিচিত ছিল না তাঁর দাদাদের কারণে।
‘বিচিত্রা’ পত্রিকায় তখন ধারাবাহিক উপন্যাস হিসেবে প্রকাশিত হচ্ছে ‘পথের পাঁচালী’। করুণার পরিবার তখন থাকেন মধ্যপ্রদেশের সুদূর এক পার্বত্য শহর বৈকুণ্ঠপুরে। তিনি লিখছেন, “কলেজ পড়ুয়া আমার দাদারা আসতেন ছুটিতে। তাঁদের মধ্যে নানা আলোচনায় সর্বজয়াকে চিনে ফেললাম।”
করুণার জন্ম ১৯১৯ সালের ২৫ ডিসেম্বর। খুলনা জেলার পয়োগ্রাম ছিল তাঁদের আদি নিবাস। বাবা শচীন্দ্রনাথ সেন, মা সুধাদেবী। তাঁর দুই দাদা, রবীন্দ্রনাথ ও আর্যকুমার। ছোট বোন করুণাকণার জন্ম সাঁওতাল পরগনার মহেশপুরে।
খুলনার ভৈরব নদ, মুর্শিদাবাদের নসিপুরের বাড়ি, পাঠশালার বন্ধুরা, ছেলেবেলার স্মৃতি হয়ে ফিরে-ফিরে এসেছে তাঁর লেখায়। কখনও আট বছর বয়সে রোম্যান্টিক কবিতা লিখে গোলাপ গাছের নীচে পুঁতে রেখেছেন। কখনও ‘বে অব বেঙ্গল’-কে ভুল করে ‘প্যাসিফিক ওশান’ বলে ফেলে দাদাদের গাঁট্টা খেয়েছেন।
করুণা স্কুলে যাননি। তা বলে পড়াশোনা বন্ধ থাকেনি কখনওই। বাড়িতে মা, বাবা, দুই দাদাই ছিলেন তাঁর শিক্ষক। বাংলা শিশুসাহিত্যের সেই স্বর্ণযুগে তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছিল বইকে সঙ্গী করে। এই বইপ্রীতি তিনি পেয়েছিলেন তাঁর মায়ের কাছ থেকে। মায়ের হাতে দেখতেন ‘প্রবাসী’, ‘বসুমতী’, ‘ভারতবর্ষ’ বা ‘বিচিত্রা’র মতো পত্রিকা। বাবা ছিলেন ডাক্তার। তিনিও পড়তে ভালবাসতেন।
প্রাইভেটে ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়ে কলকাতায় যোগমায়াদেবী কলেজে ভর্তি হন করুণা। ১৯৪১ সালে এম এ পাশ করেন। ১৯৪৩ সালে চব্বিশ বছর বয়সে করুণা সহপাঠী ও বন্ধু সুব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়কে বিয়ে করেন।
তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে। করুণার কথায়, এই বিয়ে নিয়ে তাঁদের বাড়ি থেকে যে আপত্তি উঠেছিল, তা প্রধানত রাজনৈতিক মতাদর্শগত পার্থক্যের কারণে। করুণার পরিবার ছিল গোঁড়া কংগ্রেসপন্থী আর সুব্রতরা মার্ক্সবাদী।
করুণা ও সুব্রত দু’জনেই ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে পড়তেন। সুব্রতর বাবার কাছে করুণা পড়তে আসতেন। এই আসা-যাওয়ার মধ্য দিয়ে দু’জনের মধ্যেকার সম্পর্ক আরও দানা বাঁধে।
এম এ পাশ করে কিছু দিনের জন্য সুব্রত চলে গিয়েছিলেন শান্তিনিকেতনে। সেখানে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। কিন্তু ইংরেজ গোয়েন্দাদের রবীন্দ্রনাথের স্কুলের উপরে কড়া নজর ছিল। তারা খেয়াল রাখতে চেষ্টা করত, শান্তিনিকেতনের ছাত্র-শিক্ষকরা কমিউনিস্ট চিন্তাধারার দিকে ঝুঁকে পড়ছে কি না। সেই সময়ে এই নজরদারির শিকার হন সুব্রত। তাঁকে শান্তিনিকেতন ছেড়ে চলে আসতে হয়। এর পরে জার্মানি সোভিয়েত রাশিয়া আক্রমণ করায়, পার্টির নির্দেশে সুব্রত ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। ফলে সুব্রত ও করুণা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন।
যুদ্ধ শেষে সুব্রত মুম্বইয়ে কমিউনিস্ট পার্টির মুখপত্র ‘পিপলস এজ’-এ যোগ দেন। করুণাকেও তাই মুম্বই যেতে হয়। সেখানে তিনি ভারতীয় গণনাট্য সংঘের অফিস-সম্পাদক হিসেবে যোগ দেন। বয়স তখন তাঁর ছাব্বিশ।
১৯৪৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের পরে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি বেআইনি ঘোষিত হয়। এর ফলে অনেকের সঙ্গে করুণার স্বামী সুব্রতকেও লুকিয়ে পড়তে হয় গ্রেফতার এড়াতে। কিন্তু পরে তিনি গ্রেফতার হয়ে নাসিক জেলে বন্দি হন। করুণা রাজনৈতিক ভাবে উত্তাল কলকাতায় সদ্যোজাত মেয়ে রুণকি (শম্পা)কে নিয়ে একা ও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন।
সত্যজিৎকে তিনি জানতেন সুকুমার রায়ের ছেলে তথা স্বামীর প্রতিভাবান সহকর্মী হিসেবে। বিজয়া রায় ও করুণা একই কলেজের ছাত্রী ছিলেন। সেই সূত্রে রায় পরিবারে তাঁর যাতায়াত ছিল। তাই হয়তো স্বামী, শ্বশুরের অনুরোধ ফেলতে পারেননি। ‘ভুরু কুঁচকে’ যেতেই হয়েছিল ‘মানিকের বাড়ি’।
আর তার পরে, কিছুদিনের মধ্যেই তিনি হারিয়ে গেলেন ‘সর্বজয়া’র মধ্যে। এ কিন্তু ‘অনন্যসাধারণ’ ছবি পূর্ণাঙ্গ হবার অনেক আগের কথা। ভাঙা বাড়িতে ছেঁড়া শাড়ি পরা সর্বজয়া। উঁচু করে খোঁপা বেঁধে, নাকছাবি, মাদুলি আর টিপ পরে তাঁর মনে হত, এই আমার সত্যিকারের সংসার। সম্ভবত এই বাস্তববোধের মধ্যেই সমগ্র ছবির শিল্পসৌকর্য এক অভিনব রূপ ধরেছিল।
‘পথের পাঁচালী’তে অভিনয় করে নব্য ভারতীয় তথা বাংলা চলচ্চিত্রের ঊষালগ্নের যাত্রীদলের সঙ্গী হয়েছিলেন। সর্বজয়া চরিত্র তাঁকে এক দিকে যেমন ‘জনগণের জীবন’কে ফুটিয়ে তোলার মধ্য দিয়ে বামপন্থী শিল্পকর্মীর সামাজিক দায়বদ্ধতা মেটানোর সুযোগ এনে দিয়েছিল, অন্য দিকে চলচ্চিত্রকেই তিনি মনে করেছিলেন তাঁর বহু আকাঙ্ক্ষিত প্রগতিবাদী শিল্পকর্মীর সার্থক স্থান।
‘পথের পাঁচালী’, ‘অপরাজিত’র পরে তিনি সত্যজিতের আরও দু’টি ছবি ‘দেবী’ ও ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’য় অভিনয় করেন। এ ছাড়া মৃণাল সেনের ‘ইন্টারভিউ’ ও ‘কলকাতা ৭১’, শম্ভু মিত্র ও অমিত মৈত্র পরিচালিত ‘শুভ বিবাহ’, অগ্রগামীর ‘হেডমাস্টার’, শান্তি চৌধুরীর একটি তথ্যচিত্র এবং ঋত্বিক ঘটকের অসমাপ্ত ছবি ‘কত অজানারে’-তে লেডি ডাক্তারের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন।
এ ছাড়া, ভবেন্দ্রনাথ শইকিয়ার ‘সন্ধ্যারাগ’ ও শেষ দিকে ঋতুপর্ণ ঘোষের ‘অন্ত্যেষ্টি’ ছবিতে অভিনয় করেছিলেন।
১৯৫৯ সালে ‘ব্রিটিশ অ্যাকাডেমি অব ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন আর্ট’ তাদের দ্বাদশ ব্রিটিশ ফিল্ম অ্যাওয়ার্ড (সংক্ষেপে ‘বাফতা’) দেওয়ার জন্য যে ছ’জন বিদেশি অভিনেত্রীর তালিকা তৈরি করেন তাঁদের (ইনগ্রিড বার্গম্যান, তাতিয়ানা সামজলোভা, জোয়ানে উডওয়ার্ড, গুইলেত্তা মাসিনা, আনা ম্যাগনানি) সঙ্গে ছিল করুণা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নামও।
করুণা বন্দ্যোপাধ্যায় ২০০১ সালের আজকের দিনে (১৩ নভেম্বর) ৮২ বছর বয়সে আমাদের ছেড়ে চলে যান।